ইউরোপে পর্যটনবিরোধী আন্দোলন: অতিরিক্ত পর্যটনের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের বিক্ষোভ
ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ও অঞ্চলে সম্প্রতি এক নতুন আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে — এটি হলো "পর্যটনবিরোধী" আন্দোলন। যদিও প্রথমে শুনতে কিছুটা চমকপ্রদ লাগে, তবে আন্দোলনকারীরা মূলত পর্যটকদের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছে না; বরং তারা বিক্ষোভ করছে সেই অর্থনৈতিক নীতিমালার বিরুদ্ধে, যা স্থানীয় জনগণের কল্যাণের চেয়ে পর্যটন রাজস্বকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে এই আন্দোলনের ঝাঁজ বেশি। স্পেন, ইতালি, পর্তুগাল সহ একাধিক জনপ্রিয় শহর ও দ্বীপাঞ্চলে মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে অতিরিক্ত পর্যটনের নেতিবাচক প্রভাবের বিরুদ্ধে।
প্রধান কারণ ও অভিযোগসমূহ
১. আবাসন সংকট ও ভাড়াবৃদ্ধি:
এটি সম্ভবত সবচেয়ে বড় অভিযোগ। Airbnb বা অন্য শর্ট-টার্ম রেন্টাল প্ল্যাটফর্মগুলোর বিস্তার স্থানীয়দের জন্য দীর্ঘমেয়াদী আবাসন পাওয়া কঠিন করে তুলেছে। এতে ভাড়া এতটাই বেড়েছে যে, শিক্ষকের মতো মৌলিক পেশার মানুষও তাদের নিজের শহরে থাকতে পারছেন না। আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় স্লোগান: “Your Airbnb was my home” — অর্থাৎ “তোমার Airbnb ছিল আমার বাসা।”
২. অতিরিক্ত ভিড় ও পরিকাঠামোর ওপর চাপ:
পর্যটকের সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে স্থানীয়রা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা পরিচালনা করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবা, ট্রান্সপোর্ট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহ যাবতীয় জনসেবা পর্যটকদের কারণে অতিরিক্ত চাপে পড়েছে।
৩. পরিবেশগত ক্ষতি:
ভ্রমণের কারণে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। স্পেনের মতো খরাপ্রবণ এলাকায় জল সংকট আরও গভীর হয়েছে। ক্রুজ জাহাজ, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে।
৪. স্থানীয় সংস্কৃতির ক্ষয়:
অনেক পুরনো পাড়া বা অঞ্চল এখন পর্যটকদের জন্য তৈরি রেস্টুরেন্ট, দোকান ও হোটেলে ভরে গেছে। এতে আসল লোকাল সংস্কৃতি, খাদ্য, ব্যবসা হারিয়ে যাচ্ছে। এলাকাগুলো "কমিউনিটি" থেকে পর্যটন হটস্পটে রূপান্তরিত হচ্ছে।
৫. পর্যটনের চাকরির অনিশ্চয়তা:
পর্যটন খাতে অনেক কাজ থাকলেও, সেগুলোর বেশিরভাগই মৌসুমী, কম বেতনপ্রাপ্ত এবং সুরক্ষাহীন। এতে স্থানীয়রা তাদের জীবন চালাতে আরও হিমশিম খাচ্ছেন।
৬. জমির দখল ও বাণিজ্যিক শোষণ:
বিক্ষোভকারীরা নানা সময়ে "ভূমিদস্যু ও মুনাফালোভীদের" বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, যারা পর্যটনের নামে স্থানীয়দের জীবনধারা ও আবাসন ব্যবস্থাকে শোষণ করছেন।
যে শহর ও অঞ্চলগুলোতে প্রতিবাদ হচ্ছে:
🇪🇸 স্পেন:
- বার্সেলোনা: পর্যটনবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। এখানে "Tourist Go Home" পোস্টার, জলপিস্তলে পর্যটককে ভিজিয়ে দেওয়া, শর্ট-টার্ম রেন্টাল বিরোধী প্রতিবাদ দেখা গেছে। ২০২৮ সালের মধ্যে শহরজুড়ে শর্ট-টার্ম অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।
- বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ (মায়োর্কা, ইবিজা): বাড়ি ভাড়া এবং জলসংকট নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ। ইবিজা এখন ক্রুজ জাহাজের আগমনে সীমা নির্ধারণ করেছে।
- ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ: হাজার হাজার মানুষ পর্যটকের সংখ্যা সীমিত করার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে।
- গ্রানাডা, সান সেবাস্টিয়ান, ভ্যালেন্সিয়া, মাদ্রিদ, মালাগা প্রভৃতি শহরেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
🇮🇹 ইতালি:
- ভেনিস: অত্যধিক পর্যটনে দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছে শহরটি। ডে-ট্রিপারদের জন্য প্রবেশ ফি চালু করা হয়েছে এবং স্থানীয়রা নিয়মিত প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছে।
- রোম, জেনোয়া, পালার্মো, মিলান ও ন্যাপলসেও আন্দোলনের ঢেউ দেখা গেছে।
🇵🇹 পর্তুগাল:
- লিসবন: আবাসন সংকট এবং লোকাল কমিউনিটির বিপর্যয় নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ জমেছে।
🇪🇺 অন্যান্য শহর:
অ্যামস্টারডাম, অ্যাথেন্স (Acropolis-এ দৈনিক পর্যটক সীমা নির্ধারণ), ডুব্রোভনিক, সান্তোরিনি, ব্রুজ — এসব শহরেও পর্যটনের নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে অথবা আন্দোলন শুরু হয়েছে।
আন্দোলনের কৌশল ও দাবি:
পর্যটনবিরোধী আন্দোলনকারীরা নানা রকম কৌশল অবলম্বন করছেন:
- শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা ও জনসভা
- সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি
- পর্যটকদের দিকে জলপিস্তল ছোঁড়া
- পর্যটন ব্যবসার দোকানে গ্রাফিতি আঁকা
তাদের মূল দাবি:
- শর্ট-টার্ম রেন্টাল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা
- পর্যটকের সংখ্যা নির্দিষ্ট সীমায় আনা
- টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন চালু করা
- স্থানীয়দের জীবনমানকে পর্যটনের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া
- আবাসন সংকট মোকাবিলায় সরকারি হস্তক্ষেপ
- পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ইকোলজিক্যাল ট্যাক্স আরোপ
সরকার কী করছে?
সরকারগুলো ধীরে ধীরে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু ট্যুরিজমে অর্থনৈতিক নির্ভরতার কারণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পিছপা হচ্ছে।
গৃহীত কিছু পদক্ষেপ:
- বার্সেলোনা সহ বহু শহরে শর্ট-টার্ম রেন্টাল নিষিদ্ধ ঘোষণা
- ভেনিস, সান্তোরিনি-তে পর্যটক প্রবেশ ফি চালু
- ইবিজা-তে ক্রুজ জাহাজ সংখ্যা সীমিত
- অ্যাথেন্সে অ্যাক্রোপলিস দর্শনে দৈনিক সীমা
উপসংহার
ইউরোপের পর্যটনবিরোধী আন্দোলন শুধুমাত্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়; এটি একটি গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত। অতিরিক্ত পর্যটন যেখানে একটি শহরের পরিচয়, পরিবেশ, এবং জীবনমানকে ধ্বংস করছে, সেখানে স্থানীয়দের বেঁচে থাকার লড়াই এক অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
এই আন্দোলনগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ট্যুরিজম শুধুমাত্র রাজস্ব আনার একটি মাধ্যম নয় — এটি মানবিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক ভারসাম্য বজায় রেখেই পরিচালিত হওয়া উচিত। না হলে সুন্দর শহরগুলো পর্যটকদের জন্য ফাঁকা মঞ্চ হয়ে থাকবে, আর আসল বাসিন্দারা হয়তো আর সেখানে থাকবে না।
#AntiTourism #Overtourism #EuropeProtests #BarcelonaProtests #SaveVenice #SustainableTourism #RSOSResult2025 #BengaliArticle #TourismCrisis