ভারতের গর্ব: জানুন কে ছিলেন সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত, যিনি ভারতে স্বর্ণযুগের সূচনা করেন

রাজা সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। ভারতীয় উপমহদেশের বিভিন্ন ছোট-বড় রাজ্য জয় করে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

মহারাজা সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত বংশের দ্বিতীয় শাসক। সমুদ্রগুপ্ত কবে এবং কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। কিন্তু তার রাজত্বের প্রমাণ ইতিহাসে বিদ্যমান। তাঁর শাসনকাল প্রায় 335 থেকে 380 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। সমুদ্রগুপ্তের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল এলাহাবাদের কাছে পাওয়া কৌশাম্বী শিলালিপি। যেখানে সমুদ্রগুপ্তের বিজয়ের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই শিলালিপিতে সমুদ্রগুপ্ত সম্পর্কে লেখা আছে যে "যার সুন্দর শরীর যুদ্ধের অক্ষ, তীর, বর্শা, তলোয়ার, শূল ক্ষতের সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ" যা সমুদ্রগুপ্তের বীরত্বের প্রমাণ দেয়। 

শৈশব থেকেই প্রতিভাবান: সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন ওনার পিতার প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তিনি গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত এবং লিচ্ছবি রাজকুমারী কুমারদেবীর পুত্র হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শৈশব থেকেই সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন অসাধারণ মেধাবী ও সাহসী। এই কারণে পিতা চন্দ্রগুপ্ত প্রথম সমুদ্রগুপ্তকে তার উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নেন। যদিও ওনার অন্য ছেলে ছিল, কিন্তু তিনি সমুদ্রগুপ্তের যোগ্যতা বিবেচনা করে তাকে শাসনের অধিকার দেন।


সমুদ্রগুপ্ত সাহসী হওয়ার পাশাপাশি উদারও ছিলেন।সমুদ্রগুপ্ত তাঁর রাজত্বকালে কবি, পণ্ডিত, শিল্পীদের বিশেষ স্থান দেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতির ধর্মীয়, শৈল্পিক ও সাহিত্যিক দিকগুলিকে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিলেন। তিনি ছিলেন উদার, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী একজন শাসক। রাজা সমুদ্রগুপ্ত ব্রাহ্মণ, শূদ্র, বৈষ্ণব ও শৈব ভেদাভেদ করেননি। তিনি অন্যান্য ধর্ম ও বর্ণের প্রতিও সহনশীল ছিলেন। ইতিহাসে এমন প্রমাণ রয়েছে যে রাজা সমুদ্রগুপ্ত সিলনের রাজা মেধবর্মনের পাঠানো বার্তার ভিত্তিতে বোধগয়ায় বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের জন্য বিশাল বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন। যা ইতিহাসে তার দয়া ও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে দেখা যায়। 

সমুদ্রগুপ্ত গুপ্ত বংশের দ্বিতীয় সম্রাট হিসাবে 335 খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এরপর তিনি ক্রমাগত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। প্রতিবেশী তিনটি রাজ্যের বিরুদ্ধে সমুদ্রগুপ্ত তার প্রথম আর্যাবর্ত যুদ্ধে অহিচ্ছত্র থেকে অচ্যুত নাগ , পদ্মাবতী থেকে নাগা সেনা এবং মথুরা থেকে গণপতি নাগের উপর বিজয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। ইতিহাসবিদদের মতে, সমুদ্রগুপ্ত অনেক রাজাকে জয় করেছিলেন, তিনি বন্য জাতিদের উপরও শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সীমান্ত প্রদেশের জাতিগত বীরদেরও যুদ্ধে বশীভূত করেছিলেন। পাঞ্জাব প্রদেশের অনেক প্রজাতন্ত্রের বিশাল সৈন্যবাহিনীকে জয় করে সমুদ্রগুপ্ত এগুলোকে তার সাম্রাজ্যে একীভূত করেন। উত্তরের কয়েকটি রাজ্য জয় করার পর সমুদ্রগুপ্ত তার বিজয় রথ দক্ষিণ দিকে চালান।

জাতীয় কবি রামধারী সিং দিনকর তার একটি কবিতায় লিখেছেন- 

"তুঝে ইয়াদ হে, চড়ে পদো পর, কিতনে জয়- সুমনও কি হার?

কিতনে বার সমুদ্রগুপ্ত নে, ধোই হে তুঝমে তোলওয়ার?"

প্রয়াগ প্রশস্তিতে, পল্লবদের উপর সমুদ্রগুপ্তের বিজয়ের কথাও বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণপথের যুদ্ধে সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণের 12 জন রাজাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করেন এবং উদারতা দেখিয়ে দক্ষিণের সমস্ত রাজাদের কাছে রাজ্য হস্তান্তর করেন। যার কারণে সমুদ্রগুপ্ত রাজাদের রাজা মহারাজা হন। দক্ষিণ দিকে, তিনি বঙ্গোপসাগর বরাবর তার মহান শক্তি প্রসারিত করেছিলেন। পিঠাপুরমের মহেন্দ্রগিরি, কাঞ্চির বিষ্ণুগুপ্ত, কুর্লার মন্ত্ররাজ, খোসলার মহেন্দ্র এবং   কৃষ্ণা নদীর তীর পর্যন্ত সমুদ্রগুপ্তের জয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছিল।

সমুদ্রগুপ্ত উত্তরে প্রচলিত 'দিগ্বিজয়'-এর বিরুদ্ধে 'ধর্ম বিজয়' নীতি গ্রহণ করেন। দক্ষিণের রাজাদের তাদের রাজ্য শাসনের অধিকার ও আধিপত্য দেওয়ার পর তিনি আবার উত্তর ভারতের দিকে ফিরে যায়। এরপর শুরু হয় তার দ্বিতীয় উত্তর অভিযান। কারণ সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত উত্তর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সাথে সাথেই উত্তরে বিদ্রোহ শুরু হয়। 

দক্ষিণে সমুদ্রগুপ্তের বিজয়যাত্রা সফল হয়। কিন্তু তারা ফিরে আসার পর উত্তরের অনেক রাজা আবার নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছিলেন, যা ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিদ্রোহী রাজাদের মধ্যে ছিলেন রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, চন্দ্রবর্মা, গণপতি নাগ, নাগসেন, অচ্যুত নন্দী এবং বলবর্মা। আবারও সমুদ্রগুপ্তের জন্য উত্তর ভারতের যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে সমুদ্রগুপ্ত আবারও সেইসব রাজাদের উচিত শিক্ষা শিখিয়েছিলেন যে সমস্ত রাজারা ওনার বিরুদ্ধে ভয়ানক যুদ্ধে মাথা তুলেছিলেন। 

উত্তরপথের বিদ্রোহ দমন করে সমুদ্রগুপ্ত তার বিজয়ী রথ নিয়ে আবার পুষ্পপুর অর্থাৎ পাটলিপুত্রে পৌঁছেছিলেন। সমস্ত রাজা ও রাজ্য জয় করার পর সমুদ্রগুপ্ত এটিকে তার সাম্রাজ্যে একীভূত করেন। এখন এই মহান শক্তির সামনে মাথা তোলার সাহস কারো ছিল না। সমুদ্রগুপ্তের অধীনে কামরূপ, নেপাল, আসামের নাগা অঞ্চল দেবাল এবং কুমায়ুন-গড়োয়ালের পার্বত্য অঞ্চল কর্ত্রিপুর ছিল। একই সময়ে, মালওয়া, অর্জুনায়ন, য়িধেয়া, মদ্রক, অভির, প্রজুন, সনকানিক, কাক এবং খরপরিক নামক প্রজাতন্ত্রগুলিও ওনার পরাধীনতা স্বীকার করেছিল। দক্ষিণ ও পশ্চিমের অনেক রাজা সমুদ্রগুপ্তকে খুশি রাখার জন্য উপহার পাঠাতে শুরু করেছিলেন।


সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য পশ্চিমে গান্ধার থেকে পূর্বে আসাম পর্যন্ত, উত্তরে হিমালয়ের কীর্তিপুর অঞ্চল থেকে দক্ষিণে সিংহল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সমুদ্রগুপ্তের মহাদন্ডনায়ক হরিষেণ প্রয়াগ প্রশস্তীতে লিখেছেন, 'সমস্ত পৃথিবীতে তাঁর কোনো প্রতিরূপ ছিল না। সমস্ত আর্যাবর্তকে সমুদ্রগুপ্ত তাঁর পেশী শক্তি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন।'

সমুদ্রগুপ্তের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র ভারতবর্ষে তার অবারিত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সমুদ্রগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন এবং ব্রাহ্মণ, দরিদ্র ও অনাথদের জন্য প্রচুর দান করতেন। শিলালিপিতে প্রাপ্ত প্রমাণগুলিকে অনেক বলা হয়েছে 'চিরৎসন অশ্বমেধহর্তা' এবং 'অনেকশ্বমেধয়াজি'।

মহাকবি হরিশেনের মতে, 'তাঁর মন ছিল সৎসঙ্গ আনন্দে আসক্ত। তাঁর জীবনে দেবী সরস্বতী এবং দেবী লক্ষ্মীর অনবরত আশীর্বাদ ছিল। তিনি বৈদিক ধর্মের অনুসারী ছিলেন। এমন কোন গুণ নেই যা ওনার মধ্যে ছিল না। তার শত শত দেশ জয় করার ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। পরশু, তীর, শঙ্কু প্রভৃতির ক্ষত তার শরীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত। তার নীতি ছিল পুণ্যের উত্থান এবং পাপের বিনাশ। তার হৃদয় এতই কোমল যে নিছক প্রণতিতে গলে যেত। তিনি লাখ লাখ গরু দান করেছিলেন।

রাজা সমুদ্রগুপ্তের আগ্রহ ছিল সঙ্গীত, শিল্প, প্রশাসন ও রাজনীতিতে। তিনি ছিলেন মহান বিজয়ী, দিগ্বিজয়, নীতি-বুদ্ধিসম্পন্ন শাসক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্য ও শিল্পপ্রেমিক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক। সমগ্র ভারতবর্ষকে রাজনৈতিক ঐক্যে, সাংস্কৃতিক ঐক্যে বেঁধে রাখা মহান চক্রবর্তী সম্রাটের দ্বার তখন মহান কবি ও পণ্ডিতে পরিপূর্ণ ছিল। গানের প্রতিও ওনার গভীর আগ্রহ ছিল।

ইতিহাসবিদ V.A. স্মিথ, তার যুদ্ধে বিজয়ের জন্য সমুদ্রগুপ্তকে ভারতের নেপোলিয়ন বলে অভিহিত করেছিলেন। ভারতের মহান শাসক সমুদ্রগুপ্ত তার জীবদ্দশায় কখনো পরাজিত হননি। তিনি ভারতে স্বর্ণযুগের সূচনা করেন, মুদ্রা সংক্রান্ত অনেক সংস্কার করেছিলেন, উচ্চমানের খাঁটি স্বর্ণ ও তামার মুদ্রার প্রচলন করেন। সমুদ্রগুপ্ত রৌপ্য মুদ্রা চালু করেননি। দান-খয়রাতেও তিনি খাঁটি সোনার মুদ্রা দিতেন। বায়না, বেনারস, জৌনপুর, বোধগয়া প্রভৃতি স্থান থেকে সমুদ্রগুপ্তের সাত ধরনের মুদ্রা পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে গরুড়, তীরন্দাজ, পরশু, অশ্বমেধ, বাঘ, নিহন্ত ও বীণা চিহ্নিত মুদ্রা উল্লেখযোগ্য। এগুলো তার শাসনের জাঁকজমকের প্রতীক হিসাবে রয়ে গেছে।















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4