![]() | |
| নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা সংকটে |
২০২৫ সালের বড়দিনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে বিমান হামলার নির্দেশ দেন। এই হামলাকে তিনি “খ্রিস্টানদের রক্ষার মানবিক পদক্ষেপ” বলে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু বাস্তবে এই ঘটনা আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি গভীর সংকটকে সামনে আনে। এই হামলা দেখিয়ে দেয় কীভাবে মানবাধিকার ও ধর্মীয় নিপীড়নের ভাষা ব্যবহার করে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে, আর একই সঙ্গে সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করে।
এই ঘটনাটি তিনটি বড় প্রশ্ন সামনে আনে।
প্রথমত, কীভাবে ধর্মীয় নিপীড়নের গল্প অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, কীভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো “মানবিক কারণ” দেখিয়ে একতরফাভাবে সামরিক হস্তক্ষেপ চালায়।
তৃতীয়ত, কীভাবে গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল বিশ্ব পশ্চিমা দেশগুলোর এই দ্বিচারিতা লক্ষ্য করছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের উপর আস্থা হারাচ্ছে।
ধর্ম থেকে বোমা পর্যন্ত: রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উৎস
নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলার পেছনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি খুবই স্পষ্ট। ২০২৫ সালের নভেম্বরের শুরুতে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ফক্স নিউজে একটি অনুষ্ঠান দেখেন, যেখানে নাইজেরিয়ায় “খ্রিস্টান নিধন” নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এই অনুষ্ঠান দেখার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি পেন্টাগনকে সামরিক পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেন, যদি খ্রিস্টানদের হত্যা বন্ধ না হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র “পূর্ণ শক্তি” নিয়ে নাইজেরিয়ায় প্রবেশ করবে।
এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ নেওয়া ছিল না। কয়েক মাস ধরেই মার্কিন রক্ষণশীল খ্রিস্টান সংগঠন ও ডানপন্থী মিডিয়া নাইজেরিয়ায় খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতনের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরছিল। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ নাইজেরিয়ার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব দেন। এর পর ৩১ অক্টোবর ট্রাম্প প্রশাসন নাইজেরিয়াকে “Country of Particular Concern” হিসেবে চিহ্নিত করে, যা মূলত ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের জন্য ব্যবহৃত একটি আইনি শ্রেণি।
কিন্তু এখানে সমস্যা হলো, এই আইনি ব্যবস্থা মানবাধিকার রক্ষার জন্য তৈরি হলেও, ট্রাম্প প্রশাসন এটিকে সামরিক হুমকি, সাহায্য বন্ধ এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
নভেম্বরের শেষদিকে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, নাইজেরিয়ার পরিস্থিতি খ্রিস্টধর্মের জন্য “অস্তিত্বগত হুমকি”। তিনি বলেন, প্রয়োজনে তিনি “গান্স আ ব্লেজিং” অর্থাৎ অস্ত্র হাতে নিয়ে ঢুকে পড়বেন। বড়দিনের রাতে সেই হুমকিই বাস্তবে রূপ নেয়। গিনি উপসাগরে অবস্থানরত একটি মার্কিন নৌজাহাজ থেকে এক ডজনের বেশি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।
ট্রাম্পের দাবি বনাম বাস্তব পরিস্থিতি
ট্রাম্প দাবি করেন, এই হামলা ইসলামিক স্টেটের হাতে “নিরীহ খ্রিস্টানদের নির্মম হত্যার” প্রতিশোধ। কিন্তু নাইজেরিয়ার সরকার এই বক্তব্য পুরোপুরি মানেনি। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেন, এই অভিযান কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের জন্য নয়। এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান, যা মুসলিম ও খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ভৌগোলিক বাস্তবতা। হামলা হয়েছে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সোকোটো রাজ্যে, যেখানে জনসংখ্যার প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মুসলিম। অথচ ইসলামিক স্টেটের মূল ঘাঁটি নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে। শান্তি বিশ্লেষক বুলামা বুকার্তি বলেন, ট্রাম্পের বক্তব্য বাস্তবতার সম্পূর্ণ ভুল উপস্থাপন। এই অঞ্চলে সহিংসতা সাধারণত বাজার বা জনবহুল স্থানে আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে ঘটে, যা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে লক্ষ্য করে নয়।
“খ্রিস্টান নিপীড়ন” কীভাবে রাজনৈতিক অস্ত্র হয়
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দেখায়, খ্রিস্টান নিপীড়নের ধারণা অনেক সময় পরিসংখ্যান ও সংখ্যার মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এই সংখ্যাগুলো বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতার ভান তৈরি করলেও, বাস্তবে এগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়।
আমেরিকায় অনেক ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান মনে করেন, দেশটির ভেতরে খ্রিস্টধর্মের সামাজিক প্রভাব কমছে। সেই ভয় থেকেই তারা বিদেশে খ্রিস্টান নিপীড়নের গল্পকে বড় করে তুলে ধরে। এই অভ্যন্তরীণ উদ্বেগই ধীরে ধীরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব ফেলে।
ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভিত্তির একটি বড় অংশ হলো এই ইভানজেলিক্যাল ভোটব্যাংক। তাদের সমর্থন ধরে রাখতে “খ্রিস্টানদের রক্ষা” একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ভাষা। এই ভাষার আড়ালে অন্য বাস্তব স্বার্থও কাজ করে—চীনের প্রভাব কমানো, আফ্রিকার খনিজ সম্পদের বিকল্প উৎস খোঁজা, এবং আফ্রিকায় মার্কিন উপস্থিতি দেখানো।
সার্বভৌমত্বের দ্বন্দ্ব: নিজের নীতির বিরোধিতা
২০২৫ সালের মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে সার্বভৌমত্ব, অ-হস্তক্ষেপ এবং জাতিসংঘ সনদের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্প প্রশাসন ঠিক তার উল্টো কাজ করছে।
একদিকে তারা বলে, অন্য দেশ যেন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলায়। অন্যদিকে তারা নিজেরাই একতরফাভাবে অন্য দেশের ভেতরে সামরিক হামলা চালায়। এটিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাষায় বলা হয় “আমরা ভালো উদ্দেশ্যে করেছি” যুক্তি। অর্থাৎ, আমরা হামলা করেছি ভালো জন্য, তাই এটি বৈধ।
কিন্তু এই যুক্তি খুবই বিপজ্জনক। ট্রাম্প প্রশাসন পানামা আক্রমণের হুমকি দিয়েছে, কলম্বিয়া, মেক্সিকো ও ভেনেজুয়েলায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, ব্রাজিলের ওপর শুল্ক চাপিয়েছে বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। তারা সার্বভৌমত্বের কথা বলে, আবার নিজেরাই পশ্চিম গোলার্ধে হস্তক্ষেপের অধিকার দাবি করে।
জাতিসংঘ সনদের ২(৪) ধারা স্পষ্টভাবে বলে, কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে বলপ্রয়োগ করতে পারে না। নন-অ্যালাইন্ড মুভমেন্টের ১২০টি দেশ মানবিক হস্তক্ষেপের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে। তবুও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো এই নিয়ম ভেঙে চলেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট: বাছাই করা হস্তক্ষেপ
নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের আগ্রাসী অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে তুলনা করলে দ্বিচারিতা আরও স্পষ্ট হয়। ২০২৫ সালের মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চার দিনের সংঘর্ষ হয়, যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহৃত হয়। ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি যুদ্ধবিরতি ঘটিয়েছেন।
কিন্তু ভারত স্পষ্টভাবে এই দাবি অস্বীকার করে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, এই বক্তব্য ভিত্তিহীন। ভারত জানায়, দুই দেশের সেনাবাহিনীর সরাসরি যোগাযোগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
পাকিস্তান মার্কিন হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানালেও ভারত তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখানেই পার্থক্য। যে দেশ নিজস্ব সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তিতে আত্মবিশ্বাসী, তারা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চায়। আর যারা দুর্বল, তারা বাইরের শক্তির সহায়তা খোঁজে।
বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো ছোট দেশগুলো এই বাস্তবতা দেখে “হেজিং” কৌশল নিচ্ছে—অর্থাৎ কোনো এক শক্তির ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে ভারসাম্য রক্ষা করা।
পশ্চিমা দ্বিচারিতা এবং গ্লোবাল সাউথের দৃষ্টিভঙ্গি
গ্লোবাল সাউথ বহুদিন ধরেই লক্ষ্য করছে, পশ্চিমা দেশগুলো আন্তর্জাতিক আইন বেছে বেছে প্রয়োগ করে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্ব ও মানবাধিকারের কথা বলা হয়। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের ক্ষেত্রে সেই একই মানদণ্ড প্রয়োগ করা হয় না।
এই দ্বিচারিতা পশ্চিমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। অনেক গবেষক একে “পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থার উপর আস্থার পতন” বলে বর্ণনা করেন।
নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের হামলা এই প্রবণতারই অংশ। এখানে মানবিক ভাষা ব্যবহার করে দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। সাহায্য বন্ধ, ভিসা নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক হুমকির মাধ্যমে নাইজেরিয়াকে সম্মতি দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার ভবিষ্যৎ
ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করে, তারা নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া, মানবাধিকার সংস্থার সমালোচনা করা এবং নিজের মতো করে আইন ব্যাখ্যা করা এই দাবিকে দুর্বল করে।
যদি আইন কেবল শক্তিশালীদের জন্য নমনীয় হয় এবং দুর্বলদের জন্য কঠোর হয়, তবে সেটি আর আইন থাকে না। সেটি ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
এই বাস্তবতা এশিয়ার দেশগুলোকে শিক্ষা দেয়—নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদনে জোর দেওয়া, দ্বিপাক্ষিক সমাধানের ওপর জোর দেওয়া এই চিন্তার ফল।
উপসংহার: ধর্মীয় রাজনীতি ও আধিপত্যের মিলন
নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের বিমান হামলা কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়। এটি দেখায়, কীভাবে অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় রাজনীতি, সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বাছাই করা প্রয়োগ একসঙ্গে কাজ করে।
এই হামলা কোনো গভীর আফ্রিকা-ভিত্তিক সন্ত্রাস বিশ্লেষণের ফল নয়। এটি একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের প্রভাব, ইভানজেলিক্যাল ভোটব্যাংকের চাপ এবং শক্তির রাজনীতির ফল।
নাইজেরিয়ার মতো দেশ বাধ্য হয়েছে সম্মতি দিতে, কারণ বিকল্প ছিল সাহায্য হারানো বা সরাসরি আক্রমণ। মানবিক ভাষায় মোড়ানো এই চাপই আধুনিক পশ্চিমা হস্তক্ষেপের আসল রূপ।
দক্ষিণ এশিয়ার জন্য শিক্ষা পরিষ্কার। বড় শক্তির মানবিক ভাষা সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা উচিত। নিজস্ব সামরিক ও কূটনৈতিক সক্ষমতা ছাড়া সার্বভৌমত্ব রক্ষা সম্ভব নয়। বহুমেরু বিশ্বে টিকে থাকতে হলে, প্রতিটি রাষ্ট্রকেই নিজের স্বার্থ নিজেকেই রক্ষা করতে হবে—ধর্ম, মানবতা বা গণতন্ত্রের নামে চাপিয়ে দেওয়া বাইরের ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে নয়।
