ভূমিকা: দুই দশক আগের সতর্কবার্তা, আজকের বাস্তবতা
২০২৫ সালের ২২–২৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভ থেকে প্রকাশিত কিছু গোপন নথি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড়সড় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই নথিগুলিতে ২০০১ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের মধ্যে হওয়া ৭৩টি ফোনালাপ এবং ১৯টি সরাসরি বৈঠকের হুবহু কথোপকথন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
![]() |
| ২০০১–২০০৮ সালে পুতিন ও বুশের গোপন আলোচনায় পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছিল। |
এই নথিগুলি প্রকাশের পর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর যে বিষয়টি সামনে এসেছে, তা হলো—পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে রাশিয়া ও আমেরিকা, উভয় দেশের গভীর উদ্বেগ। দুই দশক আগে ব্যক্তিগত আলোচনায় যে আশঙ্কা পুতিন প্রকাশ করেছিলেন, ২০২৫ সালের ঘটনাপ্রবাহ সেই আশঙ্কাকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে।
এই নথি প্রকাশের সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের মে মাসে পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে তীব্র সামরিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তা পারমাণবিক সংঘর্ষে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছিল। সেই প্রেক্ষাপটে এই পুরনো নথি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে—পাকিস্তানের পারমাণবিক ঝুঁকি নতুন কিছু নয়, বরং এটি বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির মাথাব্যথার কারণ।
নথি প্রকাশের পটভূমি: কেন এখন?
এই নথিগুলি প্রকাশ সম্ভব হয়েছে একটি Freedom of Information Act (FOIA) মামলার ফলে। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NARA)-এর বিরুদ্ধে মামলা করে। কারণ, NARA স্বীকার করেছিল যে তাদের প্রায় ১২ বছরের ব্যাকলগ রয়েছে, যার ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।
আদালতের চাপের ফলে দ্রুত এই নথিগুলি প্রকাশ করা হয়। এর ফলেই প্রথমবারের মতো আমরা জানতে পারি—বিশ্বের দুই প্রধান পারমাণবিক শক্তি, জনসমক্ষে যা বলত, ব্যক্তিগত আলোচনায় তার চেয়ে অনেক বেশি কঠোরভাবে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে চিন্তিত ছিল।
“পারমাণবিক অস্ত্রসহ একটি সামরিক জান্তা”: পুতিনের স্পষ্ট মন্তব্য
২০০১ সালের স্লোভেনিয়া বৈঠক
২০০১ সালের ১৬ জুন, স্লোভেনিয়ার ব্রদো ক্যাসেলে পুতিন ও বুশের প্রথম বৈঠক হয়। এই বৈঠকেই পুতিন সরাসরি বলেন—
“পাকিস্তান নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। এটি আসলে পারমাণবিক অস্ত্রধারী একটি সামরিক জান্তা। এখানে গণতন্ত্র নেই, তবু পশ্চিমা দেশগুলি কোনও সমালোচনা করে না।”
এই মন্তব্যটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, তখন পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মুশাররফের সামরিক শাসন চলছে। ১৯৯৯ সালে নওয়াজ শরিফের নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে তিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আদালত ‘doctrine of necessity’ দেখিয়ে সেই অভ্যুত্থানকে বৈধতা দিয়েছিল।
পুতিনের বক্তব্য মূলত পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতাকে তুলে ধরেছিল। ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা, অথচ পাকিস্তানের ক্ষেত্রে নীরবতা—এই বৈষম্যই তিনি প্রশ্ন করেছিলেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বুশ এই বক্তব্য অস্বীকার করেননি। অর্থাৎ, মার্কিন নেতৃত্ব ব্যক্তিগতভাবে পুতিনের মূল্যায়নের সঙ্গে সহমত ছিল।
মুশাররফের শাসন ও পারমাণবিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ
মুশাররফের আমলে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের উপর কার্যত পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল সেনাবাহিনীর হাতে। ২০০০ সালে গঠিত ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটি (NCA) কাগজে-কলমে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান হিসেবে দেখালেও বাস্তবে সিদ্ধান্ত নিত সেনাবাহিনী ও স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানস ডিভিশন।
এর ফলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবস্থাপনার উপর কোনও প্রকৃত বেসামরিক নজরদারি ছিল না। পুতিন যখন বলেন “জান্তা উইথ নিউক্লিয়ার উইপনস”, তিনি আসলে এই ব্যবস্থাকেই বোঝাচ্ছিলেন।
২০০৫: ইরানে পাকিস্তানি ইউরেনিয়াম—সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রকাশ
ওভাল অফিসের গোপন কথোপকথন
২০০৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে পুতিন ও বুশের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। এই বৈঠকেই পুতিন বলেন—
“ইরানের সেন্ট্রিফিউজে পাকিস্তানের ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে। এতে আমি খুবই চিন্তিত।”
বুশ সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করেন—
“হ্যাঁ, এই তথ্য IAEA-কে জানানো হয়নি। এটা পরিষ্কারভাবে নিয়মভঙ্গ।”
এই কথোপকথন থেকে বোঝা যায়, AQ খান নেটওয়ার্ক ধরা পড়ার পরেও পাকিস্তান–ইরান পারমাণবিক যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি বলে রাশিয়া সন্দেহ করছিল।
পুতিন বলেন, “আমাদের কথা ভাবুন।” অর্থাৎ, ভৌগোলিকভাবে রাশিয়া ইরান ও পাকিস্তানের অনেক কাছাকাছি, তাই ঝুঁকিও তাদের জন্য বেশি।
AQ খান নেটওয়ার্ক: ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক পারমাণবিক চোরাচালান
একটি বৈশ্বিক কালোবাজার
আব্দুল কাদের খান শুধু পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার জনক নন, তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক চোরাচালান চক্রের মাথা ছিলেন। তাঁর নেটওয়ার্ক ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং লিবিয়াকে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছিল।
এই নেটওয়ার্কের শাখা ছিল মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ বহু দেশে। ২০০৩ সালে লিবিয়াগামী একটি জাহাজ আটকানোর পরই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
লিবিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া
-
লিবিয়া প্রায় সম্পূর্ণ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির নকশা পেয়েছিল।
-
ইরান সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তি পায়, যার উপর আজকের সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি দাঁড়িয়ে।
-
উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে সহায়তা পায়।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল—এই সবকিছু কি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অজান্তে সম্ভব?
বুশের হতাশা: “মুশাররফ সত্য বলছেন না”
২০০৫ সালের আলোচনায় বুশ স্পষ্টভাবে বলেন—
“আমি মুশাররফকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি। হয় সে কিছুই জানে না, নয়তো সে সত্য বলছে না।”
AQ খানকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, কোনও আন্তর্জাতিক জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এর ফলে আজও পুরো সত্য অজানা।
২০২৫: পুতিনের আশঙ্কার বাস্তব প্রমাণ
ভারত–পাকিস্তান সংঘর্ষ
২০২৫ সালের মে মাসে ভারত যখন পাকিস্তানের নূর খান বিমানঘাঁটিতে আঘাত হানে—যা পাকিস্তানের পারমাণবিক কমান্ডের কাছেই—তখন আমেরিকাও ভয় পায় পরিস্থিতি “দ্রুত পারমাণবিক যুদ্ধে” গড়াতে পারে।
পাকিস্তানের ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির বৈঠকের খবর সেই আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তোলে।
পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের পারমাণবিক হুমকি
২০২৫ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির বলেন—
“আমরা যদি ডুবে যাই, তাহলে অর্ধেক পৃথিবীকে সঙ্গে নিয়ে ডুবব।”
এই বক্তব্য পারমাণবিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার স্পষ্ট উদাহরণ।
উপসংহার: শেখা হয়নি কোনও শিক্ষা
পুতিনের ২০০১ সালের সতর্কবার্তা, ২০০৫ সালের উদ্বেগ, এবং ২০২৫ সালের সংকট—সব মিলিয়ে একটি কথাই স্পষ্ট:
পাকিস্তানের পারমাণবিক সমস্যা কোনও নতুন বিষয় নয়। কিন্তু দুই দশক ধরে জানার পরেও বিশ্ব শক্তিগুলি কার্যকর সমাধান খুঁজে পায়নি।
এই নথিগুলি শুধু ইতিহাস নয়, এগুলি ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক সংকেত। কারণ, আজ যেগুলি উপেক্ষা করা হচ্ছে, সেগুলিই আগামী দিনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
আপনি কি মনে করেন পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র আন্তর্জাতিক নজরদারির আওতায় আনা উচিত?
আপনার মতামত কমেন্টে লিখুন।
