২০২৫ সালের সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে চীনের তিয়ানজিন শহরে। এ সম্মেলনে চীন, ভারত, রাশিয়া, পাকিস্তানসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেশ অংশ নেয়। কেবল কূটনৈতিক দিক থেকেই নয়, এই সম্মেলনটি বিশ্ব রাজনীতির নজর কাড়ে নানা নাটকীয় মুহূর্ত, নেতাদের বাণী এবং সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফকে ঘিরে যে সব মুহূর্ত তৈরি হয়েছে, তা তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিব্রত করেছে এবং দেশীয় রাজনীতিতেও সমালোচনার ঝড় তুলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কভারেজ ও প্রেক্ষাপট
মার্কিন সংবাদমাধ্যমের এ সম্মেলন নিয়ে উদ্বেগ এবং হতাশা প্রকাশ পেয়েছে তাদের রিপোর্টিং-এ। চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং সম্মেলনে যে বক্তব্য রাখেন, যেখানে তিনি "অজ্ঞাত দেশগুলির বুলিং আচরণ" এর সমালোচনা করেন—তা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকেই লক্ষ্য করে বলা হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এর ফলে সম্মেলনকে ওয়াশিংটন একধরনের "গ্লোবাল সাউথের ঐক্যবদ্ধতা" হিসেবে দেখছে, যা আমেরিকার প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত, রাশিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাড়তি মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের শি জিনপিংয়ের সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপচারিতা ও একসঙ্গে হাঁটার দৃশ্য গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারিত হয়। বিশেষ করে যখন ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের কারণে শুল্ক আরোপ করেছে, তখন এই দৃশ্য যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে তোলে।
শেহবাজ শরিফকে ঘিরে কূটনৈতিক নাটক
কিন্তু সব আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। সম্মেলনের সময়কার দুটি ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে তাকে প্রবলভাবে বিব্রত করেছে।
১. "উপেক্ষিত করমর্দন" ভিডিও
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটছেন। এই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ দ্রুত এগিয়ে এসে করমর্দনের চেষ্টা করেন। কিন্তু পুতিন শরিফের হাত উপেক্ষা করে এগিয়ে যান।
এই মুহূর্তকে অনেকে বলছেন "করুণ মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা" এবং পাকিস্তানের নেতার জন্য "চরম লজ্জাজনক"। টুইটার (বর্তমানে এক্স), ফেসবুক এবং ইউটিউব শর্টসে এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে এবং লাখ লাখ বার দেখা হয়। মিম, ব্যঙ্গচিত্র এবং কটাক্ষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে বিদ্রুপ করা হয়। অনেক ব্যবহারকারী লিখেছেন—“দেশকে কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থ করে বিশ্বমঞ্চে ভিখারির মতো দাঁড় করালেন শেহবাজ।”
২. মোদির "ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নয়" বার্তা
সম্মেলনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বক্তব্য ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াইয়ের আহ্বান জানান এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেন, "কোনও রকম দ্বিচারিতা গ্রহণযোগ্য নয়।"
এ বক্তব্যকে বিশ্লেষকরা পাকিস্তানকেই লক্ষ্য করে দেওয়া ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। কারণ পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের অভিযোগ হলো—তারা আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসবাদকে মদদ দিয়েছে এবং সীমান্ত অতিক্রমী সন্ত্রাসে যুক্ত রয়েছে। সেই সম্মেলন হলে সরাসরি শেহবাজ শরিফ উপস্থিত ছিলেন, ফলে মুহূর্তটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সামাজিক মাধ্যমে অনেকে লিখেছেন—“মোদির বক্তব্যে শরিফের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, যেন প্রকাশ্য মঞ্চে পাকিস্তানকে ধরা হয়েছে।”
পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক বার্তা
এই ঘটনাগুলি শুধু হাস্যরস বা ট্রোলিংয়ের বিষয় নয়; এর ভেতরে গভীর কূটনৈতিক বার্তা লুকিয়ে আছে।
১. আন্তর্জাতিক অবস্থান দুর্বল হওয়া:
পাকিস্তান বর্তমানে অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগছে। আইএমএফ ঋণ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চীনের ওপর নির্ভরশীলতা—সব মিলিয়ে দেশটির কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল। শেহবাজ শরিফের সম্মেলনে উপেক্ষিত হওয়া আসলে পাকিস্তানের হ্রাসমান আন্তর্জাতিক গুরুত্বের প্রতীক।
২. ভারতের কূটনৈতিক সাফল্য:
যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে একত্রে চলার দৃশ্য দেখালেন, সেখানে পাকিস্তান বিশ্বমঞ্চে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন রূপে ধরা দিল। ভারতের বার্তা স্পষ্ট—সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কোনো আপস নয়, আর এ বিষয়ে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করা।
৩. রাশিয়ার অগ্রাধিকার তালিকায় পতন:
এক সময় রাশিয়া-পাকিস্তান সম্পর্ক উন্নতির পথে ছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পরে রাশিয়া ক্রমে ভারত ও চীনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকেছে। পুতিনের শরিফকে উপেক্ষা করা এরই প্রতিফলন।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যম এ ঘটনায় ছিল সরব।
- এক পাকিস্তানি সাংবাদিক লিখেছেন: "এই ভিডিও আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।"
- ভারতীয় ব্যবহারকারীরা মিম বানিয়ে শরিফকে উপহাস করেছেন, অনেকেই বলছেন—“যার নিজের দেশে জনপ্রিয়তা নেই, সে বিশ্বমঞ্চে কিসের মর্যাদা চাইছে?”
- আন্তর্জাতিকভাবে অনেকে মন্তব্য করেছেন—এটি শুধু ব্যক্তিগত অপমান নয়, বরং পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতির দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এই ঘটনাকে হাতিয়ার বানিয়েছে। ইমরান খানের সমর্থকেরা বলছেন—শেহবাজ শরিফ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশকে অপদস্থ করেছেন। তারা দাবি করছেন, পাকিস্তানকে সম্মেলনে শক্তিশালী কণ্ঠস্বরের বদলে দুর্বল ও মরিয়া হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সরকারপক্ষ অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিয়েছে যে ভিডিও বা মুহূর্তগুলো অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তাদের মতে, সম্মেলনে পাকিস্তানের উপস্থিতি নিজেই একটি কূটনৈতিক সাফল্য। কিন্তু বাস্তবে জনমতের আদালতে শরিফ যে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
বিশ্লেষণ: অপমান নাকি বাস্তবতার প্রতিফলন?
শেহবাজ শরিফের এই তথাকথিত "উপেক্ষিত করমর্দন" ঘটনা নিছক কাকতালীয়ও হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভিড়ের মধ্যে এমন মুহূর্ত ঘটে থাকে। কিন্তু যেভাবে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা ব্যবহার করছে, তাতে এটি একটি বড় প্রতীকী অর্থ বহন করছে।
- এটি পাকিস্তানের হ্রাসমান কূটনৈতিক গুরুত্বকে তুলে ধরেছে।
- রাশিয়া, চীন এবং ভারতের নিকট সম্পর্কের বিপরীতে পাকিস্তান আলাদা ও দুর্বল অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে।
- মোদির বক্তব্যের সময় শরিফের উপস্থিতি আসলে সরাসরি কূটনৈতিক চাপের দিকেই ইঙ্গিত করছে।
উপসংহার
২০২৫ সালের এসসিও সম্মেলন তাই পাকিস্তানের জন্য তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়ে থাকল। যেখানে ভারত, চীন ও রাশিয়া তাদের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও মজবুত করেছে, সেখানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ হয়েছেন সামাজিক মাধ্যমের উপহাসের পাত্র।
এই ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত বা মুহূর্তভিত্তিক অপমান নয়, বরং পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি, অর্থনৈতিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানের দুর্বলতার এক নির্মম প্রতিফলন। ভবিষ্যতে পাকিস্তান যদি বিশ্বমঞ্চে মর্যাদাপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চায়, তবে তাকে শুধু কূটনৈতিক তৎপরতাই নয়, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে হবে। নইলে এমন "লজ্জাজনক মুহূর্ত" বারবারই দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।