🇮🇳 ভারত-আমেরিকা প্রতিরক্ষা বাণিজ্য ও সাম্প্রতিক শুল্ক টানাপোড়েন: এক জটিল দ্বৈত সম্পর্ক

বর্তমানে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এক জটিল মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে গভীর সহযোগিতা চলছে, অপরদিকে বাণিজ্য সংক্রান্ত টানাপোড়েন ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক আরোপ করেছে এবং আরও শাস্তিমূলক পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছে। তবুও এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজারে নিজেকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।

🔰 ভারতের প্রতিরক্ষা রপ্তানির উত্থান

দ্রুত বর্ধনশীল প্রতিরক্ষা রপ্তানি

গত কয়েক বছরে ভারত তার প্রতিরক্ষা রপ্তানিতে ব্যাপক অগ্রগতি করেছে। বর্তমানে ভারত প্রায় ১০০টিরও বেশি দেশে প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানি করে। এই দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং আর্মেনিয়া অন্যতম। ২০২৫ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা রপ্তানি প্রথমবারের মতো ২০,০০০ কোটি টাকার ঘর পেরিয়েছে, যা দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নের স্পষ্ট প্রমাণ।

বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য তালিকা

ভারতের প্রতিরক্ষা রপ্তানি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট পণ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে যে সব সামগ্রী রপ্তানি করা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে:

• বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট
• উপকূল রক্ষী বাহিনীর জন্য প্যাট্রল বোট
• হেলিকপ্টার
• হালকা ওজনের টর্পেডো
• সেন্সর সিস্টেম ও নজরদারি যন্ত্রপাতি

এই বৈচিত্র্য ভারতকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদক হিসেবে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় রাখছে।

🤝 প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি ও প্রযুক্তি বিনিময়

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গভীরতর হওয়ার পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি চুক্তি হলো:

COMCASA (Communications Compatibility and Security Agreement)

এই চুক্তি ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উন্নত ও সুরক্ষিত সামরিক যোগাযোগ সরঞ্জাম বিনিময়ের অনুমতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে যৌথ মহড়া, নজরদারি ও প্রযুক্তি হস্তান্তর আরও কার্যকর হয়েছে।

BECA (Basic Exchange and Cooperation Agreement)

এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে ভূ-স্থানিক গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করতে পারে, যা যুদ্ধ বা নজরদারির ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর।

এই চুক্তিগুলোর মাধ্যমে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ইন্টারঅপারেবিলিটি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে।

⚠️ শুল্ক ও বাণিজ্য টানাপোড়েনের বর্তমান পরিস্থিতি

শুল্ক আরোপের পেছনের কারণ

২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কিছু রপ্তানি পণ্যের উপর ২৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে, যার মধ্যে টেক্সটাইল, কেমিক্যাল, ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য রয়েছে। এই শুল্ক আরোপের পেছনে মূলত তিনটি কারণ উঠে এসেছে:

1. ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত: যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (trade surplus) অনেক বেশি, অর্থাৎ ভারত বেশি রপ্তানি করে, আমদানি কম।
2. যুক্তরাষ্ট্রীয় পণ্যে উচ্চ শুল্ক: ভারত কিছু মার্কিন পণ্যের উপর এখনও তুলনামূলকভাবে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে, বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্য ও ডেইরি প্রোডাক্টে।
3. রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক: রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন ভারত রাশিয়া থেকে তেল এবং অস্ত্র আমদানি অব্যাহত রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র এটিকে ‘গোপন মিত্রতার’ লক্ষণ হিসেবে দেখছে।

ভারতের পাল্টা প্রতিক্রিয়া

ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় তারা সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ বা ভর্তুকির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে ধরার কথাও ভাবছে ভারত।

চলমান দ্বিপাক্ষিক আলোচনা

যদিও পরিস্থিতি কিছুটা জটিল, তবুও ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। বর্তমানে উভয় দেশ একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি (Bilateral Trade Agreement) নিয়ে আলোচনায় বসেছে। কিন্তু দু’দেশের মধ্যে কৃষি, ডেইরি এবং ই-কমার্স সংক্রান্ত নীতিগত পার্থক্য এখনও সমাধান হয়নি।

🧭 সামগ্রিক প্রেক্ষাপট: একে অপরের ‘অবিশ্বস্ত মিত্র’?

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই জটিল ও বহুমাত্রিক। পরস্পরের প্রয়োজন থাকলেও বিশ্বাস ও নীতিগত ফারাক এই সম্পর্কের মূল অন্তরায়। একদিকে যেমন প্রতিরক্ষা খাতে দুই দেশের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক অবস্থান, রাশিয়া ও চীন-নীতিতে পার্থক্য এই সম্পর্ককে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ, ভারত এখনো রাশিয়ার সঙ্গে বহু প্রতিরক্ষা প্রকল্পে যুক্ত, যেমন S-400 ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্রের চোখে সন্দেহজনক। আবার আমেরিকার প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে ভারতকে চাপ দেওয়া হচ্ছে চীনের বিরুদ্ধে আরও সরব হতে, যা ভারতের জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার একটি চ্যালেঞ্জ।

🛡️ ভারতের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজার বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ—এর আকার কয়েকশো বিলিয়ন ডলার। এই বাজারে ভারতের প্রবেশ নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। তবে এটিকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করতে হলে নীতি, মানদণ্ড ও কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করেই এগোতে হবে।

সম্ভাবনার দিক

• ভারতীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের সাফল্য
• প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ
• যৌথ উন্নয়ন ও যৌথ উৎপাদনের সম্ভাবনা

চ্যালেঞ্জ

• যুক্তরাষ্ট্রের অনির্ভরশীল নীতিমালা
• ভূরাজনৈতিক চাপে স্বকীয়তা হারানোর আশঙ্কা
• মান নিয়ন্ত্রণ ও সময়মত সরবরাহের অভিজ্ঞতা কম

🔚 উপসংহার

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের দুইটি দিক—প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য—বর্তমানে একে অপরের প্রতিস্পর্ধী হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে দুই দেশের সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা সংস্থা যৌথভাবে কাজ করছে, অন্যদিকে বাণিজ্য টানাপোড়েন এই সম্পর্কের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।

তবে এটাও সত্য, বর্তমান বিশ্বের জিওপলিটিক্সে কোনও সম্পর্ক সরলরৈখিক নয়। এই বাস্তবতায়, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ গণতন্ত্রগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়াই ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক পথ।