তারার জীবনচক্র: জন্ম, বিকাশ ও মৃত্যু – মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচন


তারার জীবনচক্র: একটি মহাজাগতিক উপাখ্যান
সুপারনোভা বিস্ফোরণের ইমেজ

রাতের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের দিকে তাকালে হয়তো অনেকেই ভাবেন, এই তারা আসলে কতদিন বাঁচে? কিভাবে জন্মায়? কিভাবেই বা মারা যায়? বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন। আর প্রতিটি উত্তর আমাদের নিয়ে গেছে এক মহাজাগতিক রোমাঞ্চে, যেখানে তারার জন্ম, যৌবন, বার্ধক্য এবং মৃত্যু একটি বিরাট নাটকীয় গল্পের মতো unfolded হয়।

তারার জন্ম: মহাজাগতিক নার্সারি

তারার জন্ম হয় মহাজাগতিক গ্যাস এবং ধুলোর বিশাল মেঘ বা Nebula-তে। এই Nebula-গুলিকে তারার নার্সারি বলা হয়। এখানকার প্রধান উপাদান হলো হাইড্রোজেন গ্যাস। কোনো কারণে – যেমন কাছাকাছি সুপারনোভার বিস্ফোরণ বা গ্যালাক্টিক সংঘর্ষ – এই মেঘের নির্দিষ্ট অংশে গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায়। তখন মহাকর্ষীয় শক্তি সেই অঞ্চলটিকে সংকুচিত করতে থাকে।

এভাবে কোটি কোটি বছর ধরে সংকোচনের ফলে কেন্দ্রে প্রচণ্ড চাপ ও তাপ তৈরি হয়। একসময় এই কেন্দ্রীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা ১০ মিলিয়ন কেলভিন অতিক্রম করলে শুরু হয় পরমাণু সংযোজন বা নিউক্লিয়ার ফিউশন। তখন হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করতে শুরু করে, এবং সেই সময়েই জন্ম হয় একটি নতুন তারা।

তারার ধরণ ও জীবনকাল

তারার আয়ু নির্ভর করে মূলত এর ভরের উপর। মহাবিশ্বে দেখা যায় তিনটি প্রধান ধরনের তারা:

১️⃣ লাল বামন (Red Dwarf)
এরা সৌর ভরের ০.০৮ থেকে ০.৫ গুণের মধ্যে থাকে। সবচেয়ে ছোট ও কম উজ্জ্বল তারাগুলি এই শ্রেণীতে পড়ে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ধরনের তারা কয়েক ট্রিলিয়ন বছর পর্যন্ত স্থিতিশীল অবস্থায় থাকতে পারে। এর কারণ হলো, এরা খুব ধীরে তাদের হাইড্রোজেন পোড়ায়। আজকের মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর, অর্থাৎ এখনও কোনো লাল বামন তারার মৃত্যু আমরা দেখতে পাইনি! যখন এদের জ্বালানি শেষ হবে, তখন তারা সাদা বামনে রূপান্তরিত হবে এবং পরবর্তীতে তাপ হারিয়ে হয়ে যাবে একেবারে অন্ধকার, মৃত কালো বামন (Black Dwarf)

২️⃣ মধ্যম ভরের তারা (Sun-like stars)
আমাদের সূর্যের মতো তারার ভর সৌরের কাছাকাছি, প্রায় ১ সৌর ভর। এরা মূলত প্রধান ক্রমাবলীতে (Main Sequence) কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি করে শক্তি উৎপন্ন করে। উদাহরণ হিসেবে সূর্যের বয়স প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর এবং বিজ্ঞানীদের ধারণা, সূর্য আরও ৫ বিলিয়ন বছর টিকে থাকবে। তারপর হাইড্রোজেন শেষ হলে সূর্য ফোলাতে শুরু করবে এবং হয়ে উঠবে এক বিশাল লাল দৈত্য (Red Giant), যা পৃথিবী পর্যন্ত গিলে ফেলতে পারে। শেষ পর্যায়ে বাইরের স্তরগুলোর বিস্তার ঘটিয়ে Planetary Nebula তৈরি করে কেন্দ্রীয় অংশটি সঙ্কুচিত হয়ে রূপ নেবে সাদা বামনে।

৩️⃣ ভারি তারা (Massive stars)
যেসব তারার ভর ৮ সৌর ভরের বেশি, তারা সবচেয়ে নাটকীয় জীবনযাপন করে। প্রধান ক্রমাবলীতে এরা খুব দ্রুত হাইড্রোজেন পোড়ায় এবং কয়েক মিলিয়ন থেকে কয়েক কোটি বছরের মধ্যেই জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে। হাইড্রোজেনের পরে হিলিয়াম, কার্বন, অক্সিজেনসহ ভারী মৌলিক পদার্থও ফিউশন প্রক্রিয়ায় পোড়ায়। শেষমেষ লোহা তৈরি হলে নিউক্লিয়ার ফিউশন বন্ধ হয় কারণ লোহা ফিউশন থেকে শক্তি দেয় না, বরং শোষণ করে। তখন তারার অভ্যন্তরীণ চাপ কমে কেন্দ্রীয় অংশ ধসে পড়ে এবং ঘটে এক সুপারনোভা বিস্ফোরণ, যা সারা মহাবিশ্বে আলো ছড়িয়ে দেয়। বিস্ফোরণের পর নির্ভর করছে তারার প্রাথমিক ভর ও কেন্দ্রীয় অবশিষ্টাংশের উপর – হয় জন্ম নেবে এক নিউট্রন তারা (Neutron Star) অথবা এক ব্ল্যাক হোল (Black Hole)

তারার বার্ধক্য ও মৃত্যু

সাধারণত তারার মৃত্যুর ধরণ নির্ধারিত হয় এর ভর দ্বারা:

  • ছোট ও মাঝারি তারাগুলি ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়ে Planetary Nebula তৈরি করে এবং সাদা বামনে পরিণত হয়। এরপর কয়েক শ কোটি থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন বছর ধরে ধীরে ধীরে তাপ হ্রাস পেয়ে একসময় একেবারে নিস্তেজ কালো বামন হয়ে যায়।

  • বৃহৎ তারা হঠাৎ ভেঙে পড়ে সুপারনোভায় বিস্ফোরিত হয়, যা মহাবিশ্বে নতুন মৌল তৈরি করে। মানুষের শরীরে থাকা লোহা, ক্যালসিয়াম, এমনকি সোনাও সুপারনোভার অবদান। তাই কার্ল সাগান যেমন বলেছিলেন: “We are made of star stuff” – আমরা তারারই অংশ।

  • সুপারনোভার পর কেন্দ্রীয় অবশিষ্টাংশ যদি ৩ সৌর ভরের চেয়ে ছোট হয়, তাহলে তা নিউট্রন তারায় পরিণত হয়। আর যদি এর চেয়ে বড় হয়, তাহলে তার মহাকর্ষ এতটাই শক্তিশালী হয় যে আলোও বের হতে পারে না – তখনই সৃষ্টি হয় ব্ল্যাক হোল

তারার মৃত্যু কিন্তু চূড়ান্ত নয়

একটা তারার মৃত্যু মানে তার গল্পের শেষ নয়, বরং নতুন তারার জন্মের প্রয়োজনীয় উপাদান ছড়িয়ে দেওয়া। সুপারনোভার ধ্বংসাবশেষ থেকে পরবর্তী প্রজন্মের তারা, গ্রহ ও এমনকি প্রাণের উপাদানও গঠিত হয়। আমাদের সৌরজগতের উপাদানও এসেছে এরকম পূর্বের তারার মৃত্যুর ধ্বংসাবশেষ থেকে।

আমাদের সূর্যের ভবিষ্যৎ

বর্তমানে সূর্য প্রধান ক্রমাবলীতে স্থিতিশীল হাইড্রোজেন ফিউশন চালাচ্ছে। প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর পর এর কেন্দ্রীয় হাইড্রোজেন ফুরিয়ে যাবে। তখন কেন্দ্রীয় অঞ্চল সঙ্কুচিত হবে, বাইরের অংশ ফুলে যাবে – সূর্য হবে এক লাল দৈত্য। সেই সময়ে এটি বুধ এবং সম্ভবত শুক্রকে গিলে ফেলতে পারে। পৃথিবীর ভাগ্য অনিশ্চিত – হয়তো সূর্য গিলে ফেলবে, অথবা সূর্যের তীব্র বিকিরণে প্রাণহীন, আগুনে ঝলসানো গ্রহে পরিণত হবে।

লাল দৈত্য পর্যায়ের শেষে সূর্য Planetary Nebula তৈরি করবে, তার কেন্দ্রীয় অংশ পরিণত হবে সাদা বামনে। এই সাদা বামন কয়েক শ কোটি বছর ধরে তাপ হারিয়ে একসময় হয়ে যাবে এক নিস্তেজ, অন্ধকার কালো বামন – যদিও মহাবিশ্ব এখনো এত পুরনো নয় যে কোনো কালো বামন তৈরি হয়েছে।

মানবসভ্যতা এবং তারার জীবনচক্র

তারার জন্ম-মৃত্যুর এই গল্প শুধুই জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, আমাদের অস্তিত্বেরও গল্প। কারণ সূর্য বা অন্য তারার মৃত্যুর পরে ছড়িয়ে পড়া মৌলিক উপাদান থেকেই তৈরি হয়েছে আমাদের গ্রহ এবং আমাদের দেহ। তাই এক অর্থে আমরা সবাই প্রাচীন তারার সন্তান।

চিরন্তন মহাজাগতিক নাটক

তারার জীবনচক্র আমাদের শেখায় ধ্বংসের মাঝেই নতুন সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে থাকে। প্রতি সুপারনোভা একদিক থেকে ধ্বংস, অন্যদিকে নতুন তারকাপুঞ্জ, গ্রহ এবং সম্ভবত প্রাণের শুরু। এই চক্র কোটি কোটি, এমনকি ট্রিলিয়ন বছর ধরে চলতে থাকে। এক অর্থে, মহাবিশ্ব এক চিরন্তন নির্মাণ ও ধ্বংসের নাট্যমঞ্চ।

উপসংহার

তারার জীবনকাল ভরের উপর নির্ভরশীল। ছোট তারাগুলি ট্রিলিয়ন বছর স্থিতিশীল থেকে ধীরে নিভে যায়, মাঝারি তারাগুলি কয়েক বিলিয়ন বছরে সাদা বামনে পরিণত হয়, আর বড় তারাগুলি নাটকীয়ভাবে সুপারনোভায় বিস্ফোরিত হয়ে শেষ হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াই আমাদের শিখিয়ে দেয়, মহাবিশ্বে প্রতিটি শেষের মাঝেই নতুন শুরুর সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। প্রতিটি তারা জন্মায়, বিকশিত হয়, এবং তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বে নতুন গল্প শুরু করে।

এই মহাজাগতিক চক্র আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাতের আকাশের প্রতিটি তারা শুধু দূরবর্তী আলো নয়, একেকটি গল্পের অংশ – যাদের মধ্যে অনেকের গল্পের সাথেই জড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি।


A-breathtaking-cosmic-scene-depicting-the-life-cycle-3 A-breathtaking-cosmic-scene-depicting-the-life-cycle-2 তারার জীবনচক্র তারার জন্ম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4