ভারত ও F-35B বিতর্ক: কেরালায় ব্রিটিশ স্টেলথ ফাইটারের জরুরি অবতরণ ঘিরে বিতর্ক, নজর কাড়ল ভারতের নজরদারি ক্ষমতা

বর্তমানে ভারতের প্রতিরক্ষা মহলে এবং সামাজিক মাধ্যমে যে বিতর্ক ঘুরপাক খাচ্ছে, তা মূলত যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভির একটি F-35B লাইটনিং II স্টেলথ জেট কেরালার তিরুবনন্তপুরম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ এবং পরে ক্রিটিক্যাল হাইড্রোলিক সমস্যার কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য গ্রাউন্ডেড হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘিরে। ২০২৫ সালের ১৪ জুনের এই ঘটনাটি শুধু প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এবং সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়ে নি, সাধারণ মানুষের মধ্যেও হাস্যরস এবং মিমের উৎস হয়ে উঠেছে। যদিও অনেকেই এটিকে ভারতের F-35 কেনার সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করেছেন, বাস্তবে ভারত এখনও কোনো F-35 কেনেনি, বরং এই ঘটনা ভারতের নজরদারি ক্ষমতা এবং প্রতিরক্ষা কূটনীতির নতুন মাত্রা উন্মোচন করেছে।
F-35B কী? সংক্ষেপে পরিচয়
F-35B লাইটনিং II হল মার্কিন কোম্পানি লকহিড মার্টিনের তৈরি তৃতীয় প্রজন্মের স্টেলথ মাল্টিরোল ফাইটার। এর মূল বিশেষত্ব হলো শর্ট টেকঅফ এবং ভার্টিকাল ল্যান্ডিং (STOVL) ক্ষমতা, যা এটিকে এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার থেকে চালনা উপযোগী করে তোলে। এই বিমানটি অতি আধুনিক সেন্সর, রাডার, নেটওয়ার্কড কমব্যাট সিস্টেম ALIS/ODIN এবং অ্যাডভান্সড স্টেলথ প্রযুক্তি বহন করে, যা এটিকে শত্রুপক্ষের রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম করে। এর দাম ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যা একে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ফাইটার জেটের তালিকায় স্থান দিয়েছে।
ঘটনার পটভূমি: ব্রিটিশ ফাইটারের কেরালায় জরুরি অবতরণ
ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির বিমানবাহী রণতরী HMS Prince of Wales দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে যৌথ মহড়ায় অংশ নিতে গিয়েছিল। সেই সময় এটির অন্তর্ভুক্ত F-35B ফাইটারটি ১৪ জুন কেরালার আকাশসীমায় পৌঁছে, কিন্তু খারাপ আবহাওয়া ও জ্বালানি ঘাটতির কারণে তা তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণে বাধ্য হয়। অবতরণের পরেই বিমানটির হাইড্রলিক সিস্টেমে গুরুতর সমস্যা ধরা পড়ে এবং সেটি বিমানবন্দরের রাস্তায়ই গ্রাউন্ডেড অবস্থায় থেকে যায়।
গোপনীয়তা এবং প্রথম দফায় ভারতের সাহায্য প্রত্যাখ্যান
ভারতের প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে রয়্যাল নেভির সাথে যোগাযোগ করে হ্যাঙ্গার সুবিধা এবং কারিগরি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও প্রথম দিকে যুক্তরাজ্য তা গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। এর ফলে বিমানটি কয়েকদিন ধরে কেরালার মৌসুমি বৃষ্টির মধ্যে উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষকদের মতে, ব্রিটেনের এই গোপনীয়তা রক্ষার তৎপরতা মূলত বিমানটির অত্যন্ত গোপন প্রযুক্তি যেমন ALIS/ODIN সিস্টেম, এডভান্সড সেন্সর, এবং স্টেলথ বৈশিষ্ট্যের সুরক্ষার কারণেই।
এতে কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাজ্য চাইছিল না যে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা এয়ারক্রাফটটির সংবেদনশীল অংশে প্রবেশাধিকার পাক। কারণ, F-35-এর ALIS/ODIN সিস্টেম যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নিয়ন্ত্রণাধীন এবং এতে দূর থেকে তথ্য আদানপ্রদানের সক্ষমতা রয়েছে, যা সম্ভাব্যভাবে অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
গুপ্তচরবৃত্তির আশঙ্কা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনায় অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন, যুক্তরাজ্য কি ভারতের সঙ্গে প্রযুক্তিগত গোপন তথ্য ভাগাভাগি করতে অনিচ্ছুক ছিল? কিছু সংবাদমাধ্যম এবং প্রতিরক্ষা ব্লগে দাবি ওঠে, ব্রিটেন হয়তো আশঙ্কা করছিল ভারতের মাধ্যমে F-35-এর সংবেদনশীল প্রযুক্তি রাশিয়া বা চীনের কাছে ফাঁস হতে পারে, কারণ ভারত রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা অংশীদার।
ভারতের নজরদারি ক্ষমতার প্রমাণ
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ভারতের Integrated Air Command and Control System (IACCS)-এর সাফল্য। বিমানটি ভারতের আকাশসীমায় ঢোকার সাথে সাথেই IAF-এর IACCS সেটিকে ট্র্যাক করে এবং কন্ট্রোল টাওয়ারকে অবতরণের জন্য গাইড করে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, স্টেলথ ফাইটার হওয়া সত্ত্বেও F-35 কিভাবে ভারতের রাডারে ধরা পড়ল? পরে জানা যায়, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী F-35 তখন Luneburg Lens (রাডার রিফ্লেক্টর) যুক্ত করেই উড়ছিল, যাতে পিসটাইমে এটিকে সহজে সনাক্ত করা যায়। তবুও, ভারতের দ্রুত সাড়া ও নিরাপদ অবতরণের ব্যবস্থাপনা ভারতের নজরদারি অবকাঠামোর দক্ষতা প্রমাণ করেছে।
হাস্যরস ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
বিমানটি দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরে পড়ে থাকায় সোশ্যাল মিডিয়ায় হাস্যরসের বন্যা বয়ে যায়। কেরালা ট্যুরিজম টুইট করে “God’s Own Country welcomes the world’s most advanced guest” শিরোনামে পোস্ট দেয়। স্থানীয় একটি দুগ্ধ উৎপাদক সংস্থা তাদের দুধের বিজ্ঞাপনে F-35B-এর ছবি ব্যবহার করে, ক্যাপশন দেয় “Power for everyone, even for the world’s most powerful jet!”— যা ভাইরাল হয়ে যায়।
ব্রিটিশ প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ
অনেক টালবাহানার পরে অবশেষে ব্রিটেন ভারতের সহায়তা নিতে রাজি হয় এবং বিমানটিকে হ্যাঙ্গারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জানা গেছে, ব্রিটেন থেকে একদল বিশেষজ্ঞ এসে বিমানটির ক্রিটিক্যাল ত্রুটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে এবং প্রয়োজনে প্রতিস্থাপিত যন্ত্রাংশ আনাবে। ভারতীয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এই প্রক্রিয়ায় লজিস্টিক সহায়তা দেবে, তবে বিমানটির সংবেদনশীল সিস্টেমে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার থাকবে না।
ভারত কি F-35 কিনছে? গুজব ও বাস্তবতা
ঘটনার সাথে সাথে অনেক সংবাদমাধ্যমে F-35 কিনতে ভারতের আগ্রহ আছে কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। বাস্তবে, ভারত এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের F-35 ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও নেই। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মার্কিন প্রশাসন ভারতের কাছে F-35 বিক্রির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করলেও, ভারত বারবার স্পষ্ট করেছে, এর প্রতি আগ্রহ সীমিত এবং অনেক কৌশলগত ও আর্থিক কারণেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।
ভারত কেন F-35 কিনতে অনাগ্রহী?
১) অতিরিক্ত খরচ
F-35 বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমানগুলোর একটি। শুধু কেনার খরচই নয়, দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশন খরচও বিপুল। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাজেট ইতিমধ্যেই চাপের মধ্যে রয়েছে, যেখানে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অনেকক্ষেত্রে অর্থসংকটে জর্জরিত হতে হচ্ছে।
২) প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত নির্ভরতা
F-35 পুরোপুরি মার্কিন সফটওয়্যার এবং ALIS/ODIN সিস্টেম-নির্ভর, যা প্রতিটি বিমানের উড্ডয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং হালনাগাদের তথ্য মার্কিন নেটওয়ার্কে পাঠায়। এর ফলে ভারত সম্পূর্ণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে, যা দেশের কৌশলগত স্বাধীনতার পরিপন্থী।
৩) স্বদেশি প্রকল্প AMCA
ভারত স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে AMCA (Advanced Medium Combat Aircraft) প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এটি ৫ম প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান, যা ভারতীয় প্রযুক্তিতে তৈরি হচ্ছে। F-35 কিনলে এই প্রকল্পের অর্থায়ন ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৪) বহুবিধ যুদ্ধবিমানের বহর
ভারতের বিমানবাহিনীতে ইতিমধ্যে রাশিয়ান, ফরাসি ও দেশীয় বিমান রয়েছে। এর সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রযুক্তির F-35 যুক্ত করলে রক্ষণাবেক্ষণ, অস্ত্র সিস্টেম এবং অপারেশনাল ইন্টিগ্রেশন অত্যন্ত জটিল হয়ে যাবে।
F-35 এবং ALIS/ODIN: প্রযুক্তি ও বিতর্ক
F-35 এর অন্যতম বিতর্কিত অংশ ALIS (Autonomic Logistics Information System) এবং এর উন্নত সংস্করণ ODIN (Operational Data Integrated Network)। ALIS/ODIN ফাইটারের প্রতিটি ফ্লাইট ডেটা, প্রযুক্তিগত অবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজনীয়তা এবং মিশন রিপোর্ট রিয়েলটাইমে লকহিড মার্টিন এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কে আপলোড করে। এতে একটি দেশ বিমান কিনলেও প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকে না—এটি অনেক দেশের জন্য উদ্বেগের কারণ।
ভারতের বিকল্প যুদ্ধবিমান উদ্যোগ
F-35 কিনতে না গিয়ে ভারত নিম্নলিখিত প্রকল্পগুলিতে জোর দিচ্ছে:
- AMCA: HAL ও ADA-এর যৌথ উদ্যোগে নির্মাণাধীন ৫ম প্রজন্মের স্টেলথ ফাইটার।
- TEDBF: নেভাল প্রয়োজনে Twin Engine Deck Based Fighter।
- Tejas Mk2: বর্তমান LCA তেজসের উন্নত সংস্করণ, যা মিডিয়াম ফাইটার রোল পূরণ করবে।
- Su-30MKI এবং Rafale: ভারত ইতিমধ্যেই বহর সম্প্রসারণের জন্য এই দুই যুদ্ধবিমানে নির্ভর করছে।
উপসংহার: বিতর্কের গুরুত্ব
যদিও কেরালায় ব্রিটিশ F-35B-এর জরুরি অবতরণ নিয়ে সাময়িক বিতর্ক ও মজা হয়েছে, এই ঘটনা ভারতের নজরদারি দক্ষতা, বিমানবাহিনীর প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা কূটনীতির বাস্তবতা স্পষ্ট করে তুলেছে। ভারতীয় পক্ষে F-35 কিনতে তৎপরতা নেই, বরং দেশীয় প্রযুক্তি ও প্রকল্পগুলিতেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করছে। এ ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের সামরিক সক্ষমতার একটি বড় বার্তা দেয়, যা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা তৈরি করে।