ভূমিকা
প্রতিদিন সকালে যে সূর্যকে আমরা আকাশে দেখতে পাই, সেটিই পৃথিবীর প্রাণের উৎস। এই বিশাল তারকাটি পৃথিবীসহ আমাদের পুরো সৌরজগতকে আলো ও তাপ জোগায়। কিন্তু চিরন্তন নয় এই সূর্যও। সময়ের সাথে সাথে এর পরিবর্তন ঘটে এবং এক সময় এরও মৃত্যু হবে। কিন্তু সেই মৃত্যু হবে ধীরে ধীরে, এক দীর্ঘ মহাকাশীয় নাটকের শেষ দৃশ্য হিসেবে। এই প্রবন্ধে আমরা জানব সূর্যের ভবিষ্যৎ কেমন হতে চলেছে, এবং তা পৃথিবী ও মানব জাতির উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে।
সূর্যের বর্তমান অবস্থা
সূর্য বর্তমানে একটি প্রধান ক্রমিক (main sequence) তারকা। এটি মূলত হাইড্রোজেনকে হেলিয়ামে রূপান্তর করার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে, যার ফলে তাপ ও আলো নির্গত হয়। সূর্যের ভর প্রায় 1.99 x 10³⁰ কেজি এবং এর ব্যাস প্রায় ১৪ লক্ষ কিলোমিটার। এটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১০৯ গুণ বড় এবং এর ভর পৃথিবীর তুলনায় ৩,৩৩,০০০ গুণ বেশি।
এখন সূর্য তার জীবনের মাঝামাঝি সময়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে এটি তার কেন্দ্রে থাকা হাইড্রোজেনের বড় একটি অংশ ফিউশন করে ফেলেছে। তবে এখনও প্রচুর সময় বাকি – প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর।
৫ বিলিয়ন বছর পর কী ঘটবে?
প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর পরে, সূর্য তার কেন্দ্রে থাকা অধিকাংশ হাইড্রোজেন ব্যবহার করে ফেলবে। তখন হাইড্রোজেন ফিউশন ধীর হয়ে যাবে এবং ভারসাম্য নষ্ট হবে। তখন কেন্দ্র সঙ্কুচিত হতে থাকবে এবং বাইরের স্তরগুলো প্রসারিত ও ঠান্ডা হতে থাকবে।
এই সময় সূর্য পরিণত হবে একটি "লাল দানব" (Red Giant) তারকায়।
লাল দানব সূর্য: বিশাল, কিন্তু ঠান্ডা
একবার সূর্য লাল দানব হয়ে উঠলে, এটি বর্তমান আকৃতির প্রায় ২০০ গুণ বড় হয়ে যাবে। এখন সূর্য গ্রহ বৃহস্পতির তুলনায় ১০ গুণ বড় এবং পৃথিবীর চেয়ে ১০০ গুণ বড়। কিন্তু লাল দানব রূপে এটি এতটাই প্রসারিত হবে যে তা মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ, পৃথিবীসহ বুধ ও শুক্র সম্পূর্ণভাবে এর মধ্যে ঢুকে পড়বে।
তবে মজার বিষয় হলো, এতো বড় হয়ে উঠলেও সূর্য তার অনেকটা ভর হারাবে। ফলে এর মহাকর্ষীয় টানও দুর্বল হবে। এর ফলে বাইরের গ্রহগুলো হয়তো কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে, বা দূরে সরে যেতে পারে।
পৃথিবীর পরিণতি
এই লাল দানব রূপের সূর্য পৃথিবীকে গিলে ফেলবে। আমাদের গ্রহের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা এতটাই বেড়ে যাবে যে, সমুদ্র বাষ্প হয়ে যাবে, বায়ুমণ্ডল ধ্বংস হয়ে যাবে, আর সমস্ত প্রাণ এক সময় বিলীন হয়ে যাবে।
অর্থাৎ, সেই সময়ে যদি মানবজাতি এখনও পৃথিবীতে বাস করে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়।
তারপর কী ঘটবে?
লাল দানব রূপে সূর্য কিছু সময় স্থির থাকবে। এরপর কেন্দ্র আরও সঙ্কুচিত হতে থাকবে এবং ফিউশন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে হেলিয়াম থেকে কার্বন উৎপন্ন হতে থাকবে। যখন হেলিয়ামও শেষ হয়ে যাবে, তখন কেন্দ্র সঙ্কুচিত হয়ে একটি সাদা, জ্বলন্ত বস্তুতে পরিণত হবে, যাকে বলা হয় white dwarf বা "সাদা বামন"।
সূর্যের বাইরের স্তরগুলো তখন ধীরে ধীরে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়বে এবং তৈরি হবে একটি গ্যাসীয় মেঘ, যাকে বলা হয় planetary nebula। যদিও নামটি বিভ্রান্তিকর, এর সাথে গ্রহের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি আলোকোজ্জ্বল, রঙিন গ্যাসীয় মেঘ যা কয়েক হাজার বছর ধরে দৃশ্যমান থাকবে।
সাদা বামন: এক নিষ্ক্রিয় অবশিষ্ট
এই সময় সূর্যের কেন্দ্র অংশ, যা সাদা বামনে পরিণত হবে, তার ব্যাস হবে প্রায় পৃথিবীর সমান, কিন্তু ঘনত্ব হবে হাজার হাজার গুণ বেশি। এটি আর কোনো ফিউশন প্রতিক্রিয়া চালাবে না, কেবল ধীরে ধীরে তাপ হারাবে।
সময়ের সাথে সাথে এই সাদা বামন আরও ঠান্ডা হয়ে এক সময় হয়ে উঠবে এক black dwarf – অর্থাৎ এক শীতল, নিষ্প্রাণ তারকা, যা আর কোনো আলো বা তাপ নির্গত করে না।
মানুষের ভবিষ্যৎ কোথায়?
এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যখন সূর্য লাল দানব হয়ে পৃথিবীকে গ্রাস করবে, তখন যদি মানুষ এখনও পৃথিবীতে বাস করে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ বিলীন হয়ে যাবে। তবে যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে, তাহলে হয়তো আমরা পৃথিবী ছেড়ে অন্য গ্রহে কিংবা অন্য সৌরজগতেও বসতি গড়ে তুলতে পারব।
বর্তমানে “স্পেস কলোনি” বা মহাকাশ উপনিবেশ নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। যেমন: মঙ্গল গ্রহে বসবাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি, চাঁদে গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ, কিংবা আরও দূরের গ্রহে “এক্সোপ্ল্যানেট” খুঁজে বের করে সেখানে জীবনের সম্ভাবনা খোঁজা।
সূর্যের শেষ যেমন, সব তারকার শেষ তেমন নয়
আমাদের সৌভাগ্য যে সূর্য একটি মাঝারি ভরের তারা। কারণ এর চেয়েও বড় ও ভারী অনেক তারা থাকে, যেগুলোর শেষ হয় ভয়ংকরভাবে — সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এই ধরনের বিস্ফোরণে গোটা সৌরজগৎ ধ্বংস হতে পারে এবং কখনও কখনও গঠিত হতে পারে ব্ল্যাক হোল (Black Hole)।
তবে সূর্যের ভর এত বেশি নয়, তাই এটি শান্তভাবেই তার জীবন শেষ করবে।
কিছু আকর্ষণীয় তথ্য:
- সূর্যের বর্তমান বয়স প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর।
- প্রতিনিয়ত সূর্য তার ভরের প্রায় ৪ মিলিয়ন টন শক্তিতে রূপান্তর করে।
- সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় নেয় প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড।
- সূর্য তার পুরো জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় "main sequence" পর্যায়ে।
- সূর্য একদিন গ্রহাণুচক্রে থাকা বস্তু বা মহাকাশ যানকেও টেনে নিয়ে ধ্বংস করতে পারে, যখন তা লাল দানবে পরিণত হবে।
উপসংহার
সূর্য আমাদের জীবনের মূল ভিত্তি হলেও, একদিন এরও শেষ হবে। তবে সেই সময় এখনও অনেক দূরে। তবুও মহাবিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা আমাদের কৌতূহল ও জ্ঞানের দরজাকে প্রসারিত করে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কী হবে, মানবজাতি কি টিকে থাকবে, নাকি অন্য কোথাও জীবন খুঁজে নেবে — এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো আমরা এখনই জানি না। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত — সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলায়, এমনকি আমাদের সূর্যও।
আপনি যদি এই বিষয় নিয়ে আরও জানতে চান, বা মহাকাশ উপনিবেশ সম্পর্কে আগ্রহী হন, তাহলে পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সে বিষয়েই আলোচনা করব।