![]() |
| পাকিস্তানে ইমরান খানের কারাবন্দি হওয়া ও ২৭তম সংবিধান সংশোধনী দেশটিকে কার্যত সেনাশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে |
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট: গণতন্ত্র অবরুদ্ধ, অঞ্চল অস্থিরতার মুখে
পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কারাবন্দি হওয়া শুধুমাত্র একটি আইনি বিষয় নয়। এটি পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ওপর একটি গভীর আঘাত এবং সেই সঙ্গে প্রমাণ করে যে দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন পুরোপুরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ২০২৫ সালের নভেম্বরে পাস হওয়া ২৭তম সংবিধান সংশোধনী এই বাস্তবতাকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে, যা পাকিস্তানের ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর মোড়।
এই পরিস্থিতি শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে ভারত, দক্ষিণ এশিয়া এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ওপর।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট কী?
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট বলতে ইমরান খানের কারাবন্দি হওয়া, ২৭তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা হ্রাস এবং গণতন্ত্রের কার্যত পতনকে বোঝায়। এই সংকটের প্রভাব সরাসরি ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার ওপর পড়ছে।
কেন পাকিস্তান নিজের প্রধানমন্ত্রীকে জেলে পাঠাল
ইমরান খান, যিনি একসময় পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হন, তিনি আগস্ট ২০২৩ থেকে জেলে। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়েছে—
-
দুর্নীতি
রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস
-
বিবাহ আইন লঙ্ঘন
-
সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত অভিযোগ
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৪ বছরের সাজা দেওয়া হয়। এরপর ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রীয় উপহার (তোশাখানা) মামলায় আরও ৩ বছরের সাজা দেওয়া হয়।
কিন্তু এই মামলাগুলোর পেছনে প্রকৃত কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইমরান খান নিজে এবং বহু স্বাধীন পর্যবেক্ষক। তাঁদের মতে, এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইমরান খান যখনই কোনো মামলায় জামিন পাওয়ার চেষ্টা করেন, তখনই নতুন মামলা সামনে আসে।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির প্রকাশ্যেই বলেন—
“ইমরান খান যদি ৯ মে-র সহিংসতার জন্য ক্ষমা চান, বানিগালায় চুপচাপ বসে থাকেন, তাহলে বর্তমান ব্যবস্থা তার মেয়াদ শেষ করতে পারবে।”
এটি স্পষ্ট করে দেয় যে ইমরান খানের জেল শুধুমাত্র আদালতের সিদ্ধান্ত নয়, বরং সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
২০২২ সালের এপ্রিল মাসে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে ১৫০টিরও বেশি মামলা দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের আইনে একাধিক সাজা থাকলেও কেবল সবচেয়ে বড় সাজাটি কার্যকর হয়। ফলে আইনত মুক্তির সুযোগ কার্যত বন্ধ।
শুধু ইমরান খান নন, তাঁর দল পিটিআই (Pakistan Tehreek-e-Insaf)-এর হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককে কোনো চার্জশিট ছাড়াই আটকে রাখা হয়েছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট উদাহরণ।
জাতিসংঘে ভারতের কঠোর অবস্থান
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক আলোচনায় ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি হরিশ পার্থসারথি পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন—
“পাকিস্তান জনগণের মতকে সম্মান করে এক অনন্য উপায়ে—প্রধানমন্ত্রীকে জেলে পাঠিয়ে, শাসক দলকে নিষিদ্ধ করে এবং সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সংবিধানিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে।”
এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই প্রথম ভারত এত স্পষ্ট ভাষায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক পতনের বিষয়টি তুলল।
এই বক্তব্য আসে এমন এক সময়ে, যখন পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যু এবং সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে ভারতের সমালোচনা করছিল।
২০২৫ সালের ভারত–পাকিস্তান সামরিক উত্তেজনার পটভূমি
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হন। ভারত সরাসরি পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিদের দায়ী করে।
এর জবাবে ভারত ৭ মে ২০২৫ “অপারেশন সিন্দুর” শুরু করে এবং পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা চালায়। কয়েকদিনের তীব্র সংঘর্ষের পর ১০ মে যুদ্ধবিরতি হয়।
ভারত স্পষ্টভাবে জানায়—
পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সেনাবাহিনীর আধিপত্যই সীমান্ত সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ।
পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আক্রমণ
২৭তম সংবিধান সংশোধনী: এক সাংবিধানিক অভ্যুত্থান
২০২৫ সালের নভেম্বরে পাস হওয়া এই সংশোধনী পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিবর্তনগুলোর একটি।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে—
-
সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে আজীবন ফিল্ড মার্শাল করা হয়
-
তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্সেস হন
-
নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী সরাসরি তাঁর অধীনে চলে যায়
এর ফলে সেনাবাহিনী এখন রাষ্ট্রের ওপরে অবস্থান করছে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো—
ফিল্ড মার্শালকে আজীবন ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তিনি কোনো আইনের অধীনে জবাবদিহি করবেন না।
এ ধরনের আইন সাধারণত কেবল চরম স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে দেখা যায়।
বিচারব্যবস্থার ধ্বংস
এই সংশোধনীর মাধ্যমে একটি নতুন ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট তৈরি করা হয়েছে, যার ফলে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কমে গেছে।
আরও ভয়ঙ্কর বিষয়—
-
বিচারপতিদের সম্মতি ছাড়াই বদলি করা যাবে
-
বিচারকদের বিরুদ্ধে গোপন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে
এই ব্যবস্থার প্রতিবাদে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিচারপতি মানসুর আলী শাহ পদত্যাগ করেন।
তিনি বলেন—
“এই সংশোধনী বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি রাজনৈতিক অস্ত্র।”
পিটিআই দলের ওপর দমন-পীড়ন
২০২৫ সালের আগস্টে ১০৮ জন পিটিআই নেতাকে জেল দেওয়া হয়।
৬ জন সাংসদকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।
সরকার পিটিআইকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টাও করে—বিদেশি অর্থ গ্রহণ ও সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগ তুলে।
আজ পিটিআই নামমাত্র অস্তিত্বে রয়েছে, কিন্তু কার্যত কাজ করতে পারছে না।
পাকিস্তানে গণতন্ত্র এখন শুধু নামেই
Economist Intelligence Unit ২০২৩ সালেই পাকিস্তানকে “Authoritarian Regime” ঘোষণা করে।
আইনের শাসনের অবসান
-
শাসক ও সেনা কর্মকর্তারা আইনের ঊর্ধ্বে
-
বিরোধী নেতারা বছরের পর বছর বিচার ছাড়াই জেলে
নির্বাচন শুধু নাটক
-
ভোট হয়
-
কিন্তু ফল নির্ধারণ হয় আদালত ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে
ভারতের জন্য এর অর্থ কী
সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি বাড়ছে
একটি জবাবদিহিহীন সেনাশাসিত পাকিস্তান আবার সন্ত্রাসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত
২০২৫ সালে ভারত এই চুক্তি স্থগিত করে, যা পাকিস্তানের কৃষির জন্য মারাত্মক ধাক্কা।
চীন–পাকিস্তান সম্পর্ক
চীনও উদ্বিগ্ন, কারণ অস্থির পাকিস্তান CPEC প্রকল্পের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলছে।
পারমাণবিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
পাকিস্তানের কাছে প্রায় ১৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
২৭তম সংশোধনীর ফলে—
-
পারমাণবিক সিদ্ধান্তে কোনো বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ নেই
-
সব ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে
এটি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য ভয়ঙ্কর।
কেন বিশ্ব নজর রাখছে
-
মানবাধিকার লঙ্ঘন
-
সন্ত্রাসবাদের বিস্তার
-
পারমাণবিক ঝুঁকি
-
গণতন্ত্র ধ্বংসের উদাহরণ
সব মিলিয়ে পাকিস্তান এখন শুধু একটি দেশ নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক সংকট।
উপসংহার
ইমরান খানের জেল পাকিস্তানের সমস্যার কারণ নয়, বরং লক্ষণ।
২৭তম সংবিধান সংশোধনী পাকিস্তানে সেনাশাসনকে স্থায়ী করেছে।
ভারতের জন্য এটি একদিকে কৌশলগত সুযোগ, অন্যদিকে বড় বিপদ।
একটি দুর্বল কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে বিপদের মুখে ফেলতে পারে।
যদি পাকিস্তান দ্রুত গণতান্ত্রিক পথে না ফেরে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভবিষ্যতে আরও সংঘর্ষ, সন্ত্রাস ও অস্থিরতা অনিবার্য।
People Also Ask
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট কী?
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট বলতে ইমরান খানের কারাবন্দি হওয়া, সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক আধিপত্য, বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা এবং গণতন্ত্রের কার্যত পতনকে বোঝায়।
ইমরান খান কেন জেলে?
ইমরান খান দুর্নীতি ও তোশাখানা মামলায় দণ্ডিত হলেও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাকে রাজনীতি থেকে সরানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
২৭তম সংবিধান সংশোধনী পাকিস্তানের জন্য কেন বিপজ্জনক?
এই সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে আজীবন ক্ষমতা ও আইনি দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট ভারতের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
পাকিস্তানের অস্থিরতা সীমান্ত সন্ত্রাসবাদ, সামরিক উত্তেজনা এবং সিন্ধু জলচুক্তি সংকট বাড়াতে পারে, যা সরাসরি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত।
এই সংকট কি দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করবে?
হ্যাঁ। একটি সেনাশাসিত ও অস্থির পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাস, সামরিক সংঘর্ষ এবং পারমাণবিক নিরাপত্তা ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে।
