ট্রাম্পের ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০% ট্যারিফ: কারণ ও প্রভাব

 

ট্রাম্পের ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০% ট্যারিফ: মার্কিন চাপে রাশিয়ান তেল নীতির মূল্য দিচ্ছে ভারত

২০২৫ সালের আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বাণিজ্যে এক বড়সড় চমক এনে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভারতীয় পণ্যের উপর একসঙ্গে মোট ৫০% ট্যারিফ আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, কৌশলগত ও রাজনৈতিক দিক থেকেও একটি স্পষ্ট বার্তা দেন। এই সিদ্ধান্তের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ভারতের রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল ক্রয়। (আসল কারণ হচ্ছে, ভারত f ৩৫ ফাইটার জেট ক্রয় করবে না, সেটা স্পস্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, বরং ভারত রাশিয়ান জেট সু৫৭ এর দিকে ঝুঁকছে।) ভারত সরকারের তীব্র প্রতিবাদের পরও ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।

ভারতীয় পণ্যের উপর মার্কিন শুল্ক

ট্যারিফ কী?

ট্যারিফ হল এমন একটি কর যা একটি দেশ তার দেশে প্রবেশকারী বিদেশি পণ্যের উপর আরোপ করে। এটি মূলত তিনটি কারণে করা হয়ে থাকে:

  1. দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করা
  2. সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি
  3. কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা

এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল মূলত রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ—বিশেষ করে ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ককে টার্গেট করা।


ট্রাম্পের ট্যারিফ: কী ঘটেছে?

২০২৫ সালের ৬ আগস্ট, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন যার মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যের উপর অতিরিক্ত ২৫% ট্যারিফ আরোপ করা হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় ধাপে আরোপিত ট্যারিফ। তার আগে, এক সপ্তাহ আগেই আরেকটি ২৫% ট্যারিফ আরোপ করা হয়েছিল।

  • প্রথম ২৫% ট্যারিফ কার্যকর হয় ৭ আগস্ট থেকে।
  • দ্বিতীয় ধাপে আরোপিত অতিরিক্ত ২৫% ট্যারিফ কার্যকর হবে ২১ দিন পর।

ফলে ভারতের বহু পণ্যের উপর মোট ট্যারিফ দাঁড়ায় ৫০%, যা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ট্যারিফ কাঠামোর অধীনে এখন পর্যন্ত কোনো দেশের উপর আরোপিত সর্বোচ্চ হারে পরিণত হয়েছে।


ট্রাম্প প্রশাসনের বক্তব্য

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ট্যারিফের পেছনে ভারতের রাশিয়ান তেল ক্রয়কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার বক্তব্য, "ভারতের তেল কেনা রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রকে জ্বালানি দিচ্ছে।" এছাড়া তিনি আরও অভিযোগ করেন যে ভারত একটি "খারাপ বাণিজ্য অংশীদার" এবং ভারতের নিজস্ব ট্যারিফ অনেক বেশি।

এই বার্তা শুধুমাত্র ভারতের প্রতি নয়, বরং অন্যান্য মিত্র দেশগুলোর প্রতি একটি পরোক্ষ সতর্কবার্তা—যারা এখনও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু ইউএসএ তো নিজেও এখনো রাশিয়ার সাথে ট্রেড করে যাচ্ছে। 


ভারতের প্রতিক্রিয়া

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (MEA) ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে কড়া ভাষায় নিন্দা করে এক বিবৃতিতে জানায়:

“এই পদক্ষেপ অনৈতিক, অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক। ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে।”

MEA আরও জানায়, ভারতের তেল আমদানি পুরোপুরি বাজারভিত্তিক এবং ১.৪ বিলিয়ন জনগণের শক্তি নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য এটি অত্যাবশ্যক।


রাজনৈতিক মহলের প্রতিক্রিয়া

এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন রাজনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন:

  • শশী থারুর (কংগ্রেস): “এই ট্যারিফ আমাদের জন্য খারাপ সংবাদ। এর ফলে অনেক আমেরিকান ক্রেতার জন্য ভারতীয় পণ্য অপ্রাপ্য হয়ে উঠবে।”

  • নরেন্দ্র মোদী (প্রধানমন্ত্রী): তিনি বলেছেন, “ভারতের কৃষক, জেলে ও দুগ্ধখাতের স্বার্থে আমরা কখনোই আপস করব না—even if it comes at a personal cost।”

মোদী এই মন্তব্য করেন বিশেষ করে কৃষিপণ্য ও সামুদ্রিক খাদ্য (যেমন চিংড়ি) রফতানিতে ট্যারিফের ফলে ভারতের ক্ষতি নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে।


কোন খাতগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে ভারতের একাধিক রফতানি খাত মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  1. পোশাক ও বস্ত্রশিল্প – ভারতীয় টেক্সটাইল আমেরিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়, কিন্তু ৫০% ট্যারিফের ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
  2. চামড়াজাত পণ্য – হ্যান্ডব্যাগ, বেল্ট, জুতা প্রভৃতি পণ্যের রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
  3. রত্ন ও গয়না – বিশেষ করে হীরা ও স্বর্ণালঙ্কারের উপর এই বাড়তি ট্যারিফ একটি বড় ধাক্কা।
  4. চিংড়ি ও সামুদ্রিক খাদ্য – ভারতের অন্যতম প্রধান রফতানি খাত যা কৃষিজ পণ্যের মধ্যে অন্যতম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নতুন ট্যারিফ ব্যবস্থার কারণে ভারতের আমেরিকায় রফতানি ৪০-৫০% কমে যেতে পারে

লক্ষ্য করে দেখুন ট্রাম্প কিন্তু ভারত দেখে আমেরিকা যে ফার্মা প্রোডাক্ট আমদানি করে, তাতে ট্যারিফ বসায়নি। না বসিয়েছে ভারতে তৈরি i phone মোবাইলের ওপর।


অন্য দেশগুলোর তুলনায় ভারত কেন লক্ষ্যবস্তু?

ভারত সরকারের একটি বড় অভিযোগ হল—চীনসহ অন্যান্য দেশও রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে, কিন্তু তারা এমন কোনও ট্যারিফের মুখোমুখি হয়নি।

এর থেকে স্পষ্ট যে ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং একটি চাপ প্রয়োগের কৌশল, যার মাধ্যমে ভারতকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যে চলার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ট্রাম্প চাইছে ভারতের সাথে একটা FTA এবং সেটা আমেরিকার শর্তে। তিনি ভারতের কৃষি এবং ডেয়ারি বাজারে অবাধ প্রবেশ চাইছেন, কিন্তু ভারত নিজের কৃষকদের কথা ভেবে তাতে রাজি হচ্ছে না, তাই এই FTA সাইন হচ্ছে না। নিকি হিলিও সম্প্রতি ট্রাম্পের এই নীতির বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প যদি চিনকে ট্যারিফের জন্য তিন মাসের বরাত দিতে পারেন, তাহলে ভারতের মতো স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার(কোয়াড) কেন এই বরাত পাবে না?


ভবিষ্যৎ প্রভাব ও করণীয়

ভারতীয় রফতানিকারকরা এখন বিকল্প বাজার খুঁজতে বাধ্য হবে—উদাহরণস্বরূপ ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। কিন্তু এত দ্রুত কোনো বড় বাজার তৈরি করা সহজ নয়।

অন্যদিকে, ভারত সরকার যদি পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন পণ্যের উপর ট্যারিফ আরোপ করে, তবে তা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের রূপ নিতে পারে, যা কোনো পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।


উপসংহার

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতীয় পণ্যের উপর অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এক নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা করেছে। এই সিদ্ধান্ত ভারতের রফতানি খাতে বড় ধাক্কা দেবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই চাপের মোকাবিলা করার জন্য ভারতকে কৌশলগতভাবে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে WTO বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মেও বিষয়টি তুলে ধরতে হবে।

এই মুহূর্তে ভারতের সামনে বড় প্রশ্ন—সে কি আমেরিকার চাপে নীতিগত অবস্থান থেকে সরে আসবে, নাকি শক্ত অবস্থান নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী লাভের দিকে নজর দেবে?


আপনার মতামত জানান: এই নতুন ট্রাম্প ট্যারিফ নিয়ে আপনার কী মতামত? মন্তব্য করে জানান এবং আমাদের ব্লগটি শেয়ার করুন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4