
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, মানব ইতিহাসের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। এই যুদ্ধে আমেরিকার যোগদান ছিল তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লগ পোস্টে আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা, তাদের অভিজ্ঞতা, এবং এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঘটা স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী নিয়ে আলোচনা করব।
"ওভার দেয়ার": যুদ্ধের আহ্বান
১৯১৭ সালে "সিলেক্টিভ সার্ভিস অ্যাক্ট" এর মাধ্যমে আমেরিকা চার মিলিয়ন যুবককে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। ফ্রান্সে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করা এই যুবকদের উদ্দেশ্যে অনেক গান লেখা হয়, যার মধ্যে জর্জ এম. কোহানের "ওভার দেয়ার" গানটি সবচেয়ে বিখ্যাত। এই গানটি দেশপ্রেমের এক উদ্দীপক আহ্বান ছিল, যেখানে যুবকদের সাহসিকতার সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয় এবং তাদের পরিবার ও প্রিয়জনদের গর্বিত হওয়ার বার্তা দেওয়া হয়। গানের কয়েকটি লাইন ছিল এরকম:
"জনি, তোমার বন্দুক নাও, বন্দুক নাও, বন্দুক নাও। দৌড়ে যাও, দৌড়ে যাও, দৌড়ে যাও। শোনো তারা আমাদের ডাকছে, প্রত্যেক স্বাধীনতার সন্তানকে। তাড়াতাড়ি যাও, দেরি করো না, আজই যাও। তোমার বাবাকে গর্বিত করো এমন ছেলে পেয়ে। তোমার প্রেমিকাকে বলো মন খারাপ না করতে, গর্বিত হতে যে তার প্রিয়জন যুদ্ধে আছে।"
এই গানটি যেন যুবকদের মনে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলে।
ফ্রান্সে আমেরিকান সৈন্যদের অভিজ্ঞতা:
১৯১৭ সালের শেষের দিকে যখন আমেরিকান সৈন্যরা ফ্রান্সে পৌঁছাতে শুরু করে, তখন তাদের অধিকাংশই এক কঠিন সাংস্কৃতিক ধাক্কার সম্মুখীন হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই আগে কখনো নিজের শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যায়নি, অন্য দেশ তো দূরের কথা। ১৯১৭ সালে আমেরিকা ছিল মূলত একটি গ্রামীণ দেশ, যেখানে শুধুমাত্র উচ্চবিত্তরাই দীর্ঘ ভ্রমণে যেত। তাই, এই আমেরিকান "গ্রামের ছেলেরা" যখন প্যারিসে পৌঁছায়, তখন তাদের জন্য এক নতুন জগৎ উন্মোচিত হয়। প্যারিসের নারীরাও আমেরিকান সৈন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
কিন্তু এই নতুন পরিবেশের উত্তেজনা খুব শীঘ্রই অনিশ্চয়তা, অ্যাড্রেনালিনের স্রোত, এবং পরিখার যুদ্ধের ভীতির মধ্যে হারিয়ে যায়। আমেরিকান এক্সপেডিশনারি ফোর্সেস (AEF) নামে পরিচিত আমেরিকান সেনাবাহিনীর প্রায় এক মিলিয়ন সদস্য ইউরোপে যুদ্ধ করে, যার মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ জন প্রাণ হারায়।
স্প্যানিশ ফ্লু: যুদ্ধের পাশাপাশি এক নীরব ঘাতক
তবে, এই ১ লক্ষ প্রাণের মধ্যে অর্ধেকই যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যায়নি। বাকি অর্ধেক ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর শিকার হয়। ধারণা করা হয়, এই মহামারী প্রায় ১০ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, যা তৎকালীন বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ শতাংশ। এই মারাত্মক রোগটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উভয় পক্ষের সৈন্যদের জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসে।
যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যেই সৈন্যরা এই মহামারীর সাথেও লড়াই করতে বাধ্য হয়। একদিকে জার্মানদের সাথে যুদ্ধ, অন্যদিকে এই অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণ, পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তোলে।
জেনারেল পারশিং এবং আমেরিকার ভূমিকা:
জেনারেল জন জোসেফ "ব্ল্যাক জ্যাক" পারশিং ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে AEF এর কমান্ডার। তিনি এক দৃঢ়চেতা এবং সাহসী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান যুদ্ধ এবং স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন।
পারশিংয়ের কাজ ছিল মূলত একটি নতুন সেনাবাহিনী তৈরি করা এবং মিত্রশক্তির কমান্ডারদের অহংকার ও অবজ্ঞা মোকাবেলা করা। ব্রিটিশ ও ফরাসি কমান্ডাররা চেয়েছিল আমেরিকান সৈন্যরা তাদের অধীনে কাজ করুক, কিন্তু পারশিং এর তীব্র বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত, কিছু কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য ফরাসিদের অধীনে কাজ করার অনুমতি পায়, কিন্তু বাকি আমেরিকান সৈন্যরা নিজেদের পতাকা তলে যুদ্ধ করে।
জার্মানির শেষ আক্রমণ, "স্প্রিং অফেনসিভ" (মার্চ-জুলাই ১৯১৮), মিত্রশক্তির জন্য এক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে। কিন্তু আমেরিকান সৈন্যদের দৃঢ়তা এবং সাহসিকতা মিত্রশক্তির মনোবল বৃদ্ধি করে।
শত দিবসের আক্রমণ এবং আমেরিকার বিজয়:
জার্মানির স্প্রিং অফেনসিভ ব্যর্থ হওয়ার পর, মিত্রশক্তি জার্মানির উপর পাল্টা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। আমেরিকান সৈন্যদের যোগদানে মিত্রশক্তির শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়।
১৯১৮ সালের ৮ই আগস্ট মিত্রশক্তি একযোগে আক্রমণ শুরু করে, যা "শত দিবসের আক্রমণ" নামে পরিচিত। এই আক্রমণে আমেরিকান সৈন্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা সেন্ট মিহিয়েল এবং আর্গন অঞ্চলে জার্মানদের পিছু হটতে বাধ্য করে এবং ১৬,০০০ বন্দীকে আটক করে।
যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত निर्णायक। আমেরিকান জনবলের যোগান মিত্রশক্তিকে জার্মানির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় এনে দেয়। এই যুদ্ধ আমেরিকার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, যা তাদের বিশ্ব মঞ্চে এক নতুন শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার যোগদান, তাদের সৈন্যদের অভিজ্ঞতা, স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর প্রভাব, এবং জেনারেল পারশিংয়ের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করলাম। এই যুদ্ধ শুধু সামরিক ইতিহাসের একটি অংশ নয়, বরং এটি মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা আমাদের অনেক শিক্ষা দেয়।