প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং আমেরিকা: প্রচার, বিভাজন এবং পরিবর্তন

19a9d54e-96a6-428c-9cd6-3868b632d92d

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই যুদ্ধে আমেরিকার যোগদান এবং তার আগের পরিস্থিতি নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব।

যুদ্ধের শুরুতে আমেরিকা নিরপেক্ষ ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন ঘটনা তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করে। এর পেছনে ছিল শক্তিশালী প্রচার, অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন ও পরিবর্তন।

জার্মান-বিরোধী প্রচার এবং "হান" এর ধারণা:

যুদ্ধ যতই চলতে থাকল, আমেরিকায় জার্মানির বিরুদ্ধে প্রচার বাড়তে লাগল। ব্রিটিশ প্রচারপত্র আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পৌঁছাতে শুরু করলো, যেখানে জার্মানদের "হান" বলে উল্লেখ করা হতো। কিন্তু কেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জার্মানদের ১০০০ বছর আগের একটি জাতির সাথে তুলনা করা হলো, যাদের সাথে তাদের কোনো সরাসরি সম্পর্ক ছিল না?

এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। হুনদের নেতা ছিলেন অ্যাটিলা, যা একটি ভীতিকর নাম। হুনরা একসময় ইউরোপের ত্রাস ছিল। তারা মূলত এশিয়া থেকে এসে চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে রোমান সাম্রাজ্য তছনছ করে দেয়। হুনদের নৃশংসতার কারণে তারা অনেক জার্মান কিংবদন্তির অংশ হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় কারণটি সম্ভবত হুনদের হিংস্রতা। তারা সমগ্র জনগোষ্ঠীকে হত্যা করার জন্য পরিচিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মানরা যখন বেলজিয়াম আক্রমণ করে, তখন স্থানীয় প্রতিরোধের মুখে তারা বেসামরিক জনগণের উপর কঠোর প্রতিশোধ নেয়, যা "বেলজিয়ামের ধর্ষণ" নামে পরিচিত। এই ঘটনার পরেই প্রাচীন হুনদের সাথে জার্মানদের তুলনা শুরু হয়।

তৃতীয়ত, কাইজার উইলিয়াম দ্বিতীয় ১৯০০ সালে বক্সার বিদ্রোহে (Boxer Rebellion) অংশগ্রহণকারী জার্মান সৈন্যদের বিদায়ী ভাষণে হুনদের কথা ইতিবাচকভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "যখন তোমরা শত্রুর সাথে মিলিত হবে, তারা পরাজিত হবে! কোনো ক্ষমা করা হবে না! কোনো বন্দি নেওয়া হবে না! যারা তোমাদের হাতে পড়বে তারা তোমাদের সম্পত্তি! যেমন হাজার বছর আগে রাজা এটজেলের অধীনে হুনরা নিজেদের পরাক্রম ও কিংবদন্তির মাধ্যমে পরিচিত করেছিল, তেমনই তোমরা চীনে ১০০০ বছর ধরে জার্মানদের নাম প্রতিষ্ঠা করবে, যাতে কোনো চীনা আর কোনো জার্মানের দিকে বাঁকা চোখে তাকানোর সাহস না করে।"

কিন্তু প্রচার কার্যকর হওয়ার জন্য এর পেছনে কিছু সত্যতা থাকা দরকার। শুধু জার্মানদের "হান" বললে সাধারণ আমেরিকানদের উপর তেমন প্রভাব পড়ত না। বেলজিয়ামের জনগণের উপর অত্যাচারের কাহিনীও তাদের তেমন স্পর্শ করত না। আমেরিকার উপর সরাসরি আঘাত বা আমেরিকানদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রয়োজন ছিল।

লুসিতানিয়া জাহাজডুবি:

টাইটানিকের জাহাজডুবির কথা সবার জানা। এর প্রায় তিন বছর পর, ১৯১৫ সালের ৭ই মে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। জার্মান ইউ-বোট (U-boat) থেকে ছোড়া টর্পেডোতে ডুবে যায় আরএমএস লুসিতানিয়া (RMS Lusitania) নামক একটি যাত্রীবাহী জাহাজ। প্রায় ২০০০ যাত্রীর মধ্যে ১১৯৮ জন মারা যায়, যাদের মধ্যে ১২৮ জন আমেরিকান ছিল। এই ঘটনা জার্মানদের জন্য একটি মারাত্মক জনসংযোগ বিপর্যয় ছিল এবং আমেরিকার জনমতকে যুদ্ধের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।

জিমারম্যান টেলিগ্রাম:

শেষ আঘাতটি আসে জিমারম্যান টেলিগ্রামের মাধ্যমে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জিমারম্যান মেক্সিকো সরকারকে একটি তারবার্তা পাঠান, যেখানে তিনি প্রস্তাব দেন যে আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দিলে জার্মানি মেক্সিকোকে ১৮৪৬-১৮৪৮ সালের মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধে হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে। ব্রিটিশরা এই টেলিগ্রাম ধরে ফেলে এবং আমেরিকানদের হাতে তুলে দেয়। এই ঘটনার পর আমেরিকায় যুদ্ধে যোগ দেওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়।

যুদ্ধ ঘোষণার পর দেশের অবস্থা:

১৯১৭ সালের ২রা এপ্রিল আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধ ঘোষণার পর, বেশিরভাগ আমেরিকান যুদ্ধের সমর্থনে আসে, যদিও কিছু মানুষ এর বিরোধিতা করে।

সরকার খাদ্য ও জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ আইন (Food and Fuel Control Act) জারি করে এবং হার্বার্ট হুভারের (Herbert Hoover) নেতৃত্বে একটি খাদ্য প্রশাসন (Food Administration) গঠন করে। এই প্রশাসন খাদ্য সম্পর্কিত প্রচার চালায় এবং "মাংসবিহীন মঙ্গলবার," "মিষ্টিবিহীন শনিবার," "শুয়োরের মাংসবিহীন" মঙ্গলবার ও শনিবার এবং "গমবিহীন" সোমবার ও বুধবারের মতো নিয়ম চালু করে।

জার্মান-আমেরিকানরা কিছু অঞ্চলে বৈষম্যের শিকার হয় এবং কেউ কেউ সহিংসতার শিকারও হয়। এর কারণে অনেক জার্মান ও জার্মান-আমেরিকান তাদের নাম পরিবর্তন করে ফেলে।

গুপ্তচরবৃত্তি আইন এবং রাষ্ট্রদ্রোহ আইন:

সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ আমেরিকা এবং তাদের মিত্ররা আমেরিকার যুদ্ধে যোগদানের পরেও যুদ্ধের বিরোধিতা করতে থাকে। এর ফলে সরকার ১৯১৭ সালে গুপ্তচরবৃত্তি আইন (Espionage Act) এবং ১৯১৮ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন (Sedition Act) পাস করে। এই আইনের মাধ্যমে যুদ্ধের বিরোধিতা করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এই আইনের অধীনে সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা ইউজিন ভি. ডেবসকে (Eugene V. Debs) দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা আইন:

আমেরিকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের সময়টি "প্রগতিশীল যুগ" (Progressive Era) নামে পরিচিত। এই সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা মনে করতেন যে দেশের আইন পরিবর্তন করা দরকার। এই সময়ে অনেক নতুন আইন ও সরকারি সংস্থা তৈরি হয়।

মার্কিন সামরিক বাহিনীও এই সময়ে সংস্কারের প্রয়োজন বোধ করে। ১৯১৭ সালে আমেরিকার তেমন কোনো স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না। তাই সরকার একটি বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা (draft) চালু করে। ১৯১৭ সালের ১৮ই মে কংগ্রেস "সিলেক্টিভ সার্ভিস অ্যাক্ট" (Selective Service Act) পাস করে, যার মাধ্যমে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী সকল পুরুষ নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক নিবন্ধন করা হয়।

Doughboy দের আগমন:

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যদের "Doughboy" বলা হতো। এই শব্দটি মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল।

এই সমস্ত ঘটনা আমেরিকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। প্রচার, অভ্যন্তরীণ বিভাজন, নতুন আইন এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান - সবকিছুই এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল।

128bbf6d-3714-4a43-8dc5-4189bbb2f264

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4