আপনি নিশ্চয়ই মুঘল ও রাজপুতদের যুদ্ধের কথা শুনেছেন। ঘাসের রুটি খেয়ে আকবরের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে লড়ে যাওয়া মহারানা প্রতাপ এবং বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শত ক্ষত সহকারে রানা সাঙ্গার বীরত্বের কথা সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। তাদের গল্প আজ প্রায় ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তবে আজ আমরা আপনাকে এমন কিছু যোদ্ধার কথা বলতে যাচ্ছি, যারা মুঘলদের ঘাম ঝরিয়ে দিয়েছিলেন। এরা অসমের আহোম যোদ্ধা। আসাম প্রাচীনকালে কামরূপ বা প্রজ্ঞাজ্যোতিষপুর নামে পরিচিত ছিল। এর রাজধানী ছিল আধুনিক গুয়াহাটি। এই সাম্রাজ্যের অধীনে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর, বাংলার কোচ-বিহার এবং ভুটান অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মুঘলদের যেমন মারাঠাদের কাছে বারবার প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়েছিল, তেমনি আহোমরাও মুঘলদের বহুবার পরাজিত করেছিল। দুই পক্ষের মধ্যে ১৮ টির বেশি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বেশির ভাগ সময়ই, হয় মুঘলদের বিতাড়িত করা হয়, অথবা জয়ের পরও মুঘলরা সেখানে তাদের প্রভাব বজায় রাখতে পারেনি। 17 শতকের আহোম যোদ্ধা লাচিত বারপুখানকে এখনও আসামে স্মরণ করা হয়। তার নেতৃত্বেই আহোমরা পূর্বাঞ্চলে মুঘলদের সম্প্রসারণবাদী অভিযান বন্ধ করে দেয়। 1667 সালের আগস্ট মাসে তিনি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে মুঘল সেনা চৌকিতে আক্রমণ করেন। লাচিত গুয়াহাটি পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং মুঘল সেনাপতি সৈয়দ ফিরোজ খান সহ অনেক মুঘল সৈন্যকে বন্দী করেন।
মুঘলরাও বসে থাকেনি। অপমানিত বোধ করে, মুঘলরা আহোমদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রচুর সৈন্য পাঠায়। শত শত নৌকায় মুঘল সৈন্যরা নদী পার হয়ে আহোমদের সাথে একটি বড় সংঘর্ষে এগিয়ে যায়। এবার মুঘলরা খুব শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল। কিন্তু, এবার যা হল ত ইতিহাসের প্রতিটি বইয়ে পড়ানো উচিত, যেখানে 'নৌ যুদ্ধ' বা জলযুদ্ধের কথা আসে। লাচিতের নেতৃত্বে আহোম সৈন্যরা এসেছিল মাত্র ৭টি নৌকায়। তিনি মুঘল বাহিনী এবং তাদের নৌযানগুলোকে এমনভাবে আক্রমণ করেন যে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মুঘলরা চরম পরাজয় বরণ করে। এই জয়ের পর লাচিত নামের মহান যোদ্ধার মৃত্যু হয়, কিন্তু এই পরাজয়ের পর মুঘলরা পূর্বাঞ্চলের দিকে তাকানো বন্ধ করে দেয়। মুঘলদের এই পরাজয়ের চিত্রনাট্য বুঝতে হলে আরেকটু পেছনে যেতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে, লাচিতের এই কৃতিত্বের 50 বছর আগে মুঘল এবং অহোমদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছিল। 1615 সালেই, মুঘলরা আবু বকরের নেতৃত্বে একটি সেনা পাঠায়, যা আহোমদের কাছে পরাজিত হয়। শুরুতে আহোমদের ব্যাপক ক্ষতি হলেও শেষ পর্যন্ত তারা মুঘলদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। প্রকৃতপক্ষে এই সংঘাত এইভাবে শুরু হয় - 1515 সালে কোচ-বিহারে কোচ রাজবংশ শুরু হয়েছিল। বিশ্ব সিং এই রাজবংশের প্রথম রাজা হন। তার পুত্র নর নারায়ণ দেবের মৃত্যুর পর এই সাম্রাজ্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তাঁর ভাগ্নে রঘুদেব পূর্ব অংশে যান এবং তাঁর পুত্র লক্ষ্মী নারায়ণ পশ্চিম অংশের দায়িত্বে ছিলেন। তাই পরিবারের এই দুই অংশের মধ্যে সাম্রাজ্য-এর অধিকার নিয়ে একটা ছোটখাটো মনোমালিন্য ছিলই। মুঘলদের সাথে লক্ষ্মী নারায়ণের প্রচুর মেলামেশা ছিল। অপরদিকে আহোম রাজা সুখামপা রঘুদেবের কন্যাকে বিয়ে করেন এবং পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এখান থেকেই শুরু হয় সব লড়াই।
উর্বর জমি, সুগন্ধি গাছপালা ও প্রাণী বিশেষ করে হাতির কারণে কামরূপ অঞ্চলটি সমৃদ্ধ ছিল এবং এটি এই এলাকার উপর মুঘলদের কুদৃষ্টির একটি বড় কারণ ছিল। আহোমরা এক পাহাড়ি সেনাপতিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মুঘলরাও তার উপর ক্ষুব্ধ ছিল। শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ছেলেরা ক্ষমতার জন্য নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছিল। এই বিরোধের সুযোগ নিয়ে আহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহ মুঘলদের আসাম থেকে তাড়িয়ে দেন। তিনি গুয়াহাটি পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু, আসল সমস্যা দেখা দেয় যখন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার মীর জুমলাকে ওই এলাকায় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠান।
1662 সালের মার্চ মাসে মীর জুমলার নেতৃত্বে মুঘলরা দারুণ সাফল্য পায়। আহোমদের অভ্যন্তরীণ কলহের সুযোগ নিয়ে তিনি সিমুলগড়, সমধারা ও গড়গাঁও দখল করেন। মুঘলরা 82টি হাতি, 3 লাখ সোনা ও রৌপ্য মুদ্রা, 675টি বড় বন্দুক, 1000টি জাহাজ পেয়েছিল। এগুলো ছাড়াও অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। কিন্তু, শীত আসার সাথে সাথে মুঘলরা সেখানকার আবহাওয়ায় অসুবিধার সম্মুখীন হতে শুরু করে এবং দিল্লির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে মুঘলরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। বর্ষাকাল আসার সাথে সাথে মুঘল এবং অহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহের মধ্যে আবার যুদ্ধ হয়, কিন্তু অহোমদের পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়।যুদ্ধের খতিবাবদ আহোমদের 1 লক্ষ টাকা দিতে হয়েছিল এবং অনেক এলাকা হারাতে হয়েছিল। অহোমদের একপ্রকার বাধ্য হয়েই 'গিলাজারিঘাট সন্ধি' করতে হয়েছিল। জয়ধ্বজকে তার মেয়ে এবং ভাতিজিকে মুঘল হারামে পাঠাতে হয়েছিল।
জয়ধ্বজ এই অপমান সইতে পারলেন না। তিনি এরপর মারা যান। প্রজাদের রক্ষার জন্য বাধ্য হয়েই তাকে বিদেশী হানাদারদের সাথে এই চুক্তি করতে হয়েছিল। জয়ধ্বজের পুত্র চক্রধ্বজ এটাকে অপমান হিসেবে নিয়ে মুঘলদের তাড়িয়ে দিতে শুরু করেন। তিনি মুঘলদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে মানস নদীর তীর অবধি নিয়ে যান এবং মীর জুমলার হাতে বন্দী সকল আহোম সৈন্যদের মুক্ত করে আনেন। আহোমরা তাদের হারানো জমি ফিরে পায়। গুয়াহাটি থেকে মুঘলদের বিতাড়নের পর মানস নদীকে সীমান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর পর চক্রধ্বজ বলেছিলেন, এখন তিনি ঠিকমতো শান্তিতে বসে খাবার খেতে পারবেন।
এই অপমানের পর, আওরঙ্গজেব আসামে একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী পাঠান, কিন্তু ঐতিহাসিক সরাইঘাটের যুদ্ধে লাচিত বোরপুখানের হাতে তাকে ভারী পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়। উপরে আমরা এই যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছি, যার পরে মুঘলদের বিরুদ্ধে অভিযানের নতুন নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন লাচিত। 50,000-এরও বেশি সংখ্যায় আসা মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করতে তিনি জলযুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করেন। ব্রহ্মপুত্র নদ ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকাকে নিজের শক্তিতে পরিণত করে লাচিত মুঘলদের অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়েন। উনার যুদ্ধকৌশল নীতি বা দূরদর্শিতা এতটাই তীব্র ছিল যে,তিনি জানতেন স্থলভাগে মুঘল বাহিনী যতই শক্তিশালী হোক না কেন, কিন্তু জলে তাদের পরাজিত করা যেতে পারে।
লাচিত নদীতে সামনে ও পেছন উভয় দিক থেকে মুঘলদের আক্রমণ করেন। মুঘল বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তাদের কমান্ডার মুনাওয়ার খান নিহত হন।
আসাম সরকার 2000 সালে লাচিত বোরপুখান পুরস্কার প্রতিষ্ঠা করে। 'ন্যাশনাল ডিফেন্স একাডেমি' থেকে উত্তীর্ণ হওয়া সেরা মেধাবীরা এই সম্মান পান। আজও আসামে তাঁর মূর্তি স্থাপন করা হয়। তাই আমাদের অবশ্যই অহোম যোদ্ধাদের মনে রাখতে হবে যারা মারাঠা এবং রাজপুতদের মতোই আরো অনেক ভারতীয় রাজ্যের সমজাতীয় ছিল যারা মুঘলদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। আজও 24 নভেম্বর 'লাচিত দিবস' হিসেবে পালিত হয়।