ভূমিকা
২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিচ্ছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলির মধ্যে জোট গঠনের প্রবণতা, সামরিক মহড়া এবং বাণিজ্যিক চাপ—সব মিলিয়ে একটি বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাশিয়ার "জুলাই স্টর্ম" নৌ মহড়া, চীন-রাশিয়ার যৌথ সামরিক অনুশীলন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবমেরিন মোতায়েন এবং কোয়াড সম্মেলন ঘিরে অনিশ্চয়তা—এই ঘটনাগুলো একে অপরের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত এবং গভীর কৌশলগত তাৎপর্য বহন করে।

রাশিয়ার “জুলাই স্টর্ম” নৌ মহড়া: শক্তি প্রদর্শনের বার্তা
২০২৫ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত রাশিয়া একটি বৃহৎ সামুদ্রিক মহড়া পরিচালনা করে যার নাম ছিল "জুলাই স্টর্ম"। এই মহড়ায় অংশগ্রহণ করে—
- ১৫০টিরও বেশি যুদ্ধজাহাজ
- ১২০টিরও বেশি বিমান
- ১৫,০০০ এর বেশি নৌবাহিনীর কর্মী
এই অনুশীলনটি অনুষ্ঠিত হয় রাশিয়ার চারটি প্রধান নৌবহরের অংশগ্রহণে: প্যাসিফিক, আর্কটিক, বাল্টিক এবং ব্ল্যাক সি ফ্লিট। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল "অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল" অনুশীলন করা, যার মধ্যে ছিল:
- সাবমেরিন প্রতিরক্ষা
- দূরপাল্লার অস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার
- সমন্বিত অপারেশন ও প্রতিক্রিয়া সক্ষমতা যাচাই
এই মহড়া মূলত ইউক্রেনে রাশিয়ার "বিশেষ সামরিক অভিযান" থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চীন-রাশিয়া: "নো-লিমিটস" কৌশলগত অংশীদারিত্ব
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ঠিক পূর্বে চীন ও রাশিয়া ঘোষণা করে তাদের "নো-লিমিটস পার্টনারশিপ"। এই অংশীদারিত্ব দিন দিন আরও গভীর হচ্ছে। যদিও চীন আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে, বাস্তবে তারা:
- রাশিয়াকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে
- একাধিক যৌথ সামরিক অনুশীলনে অংশ নিচ্ছে
- মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়ার প্রভাব হ্রাসে সচেষ্ট
এই জোট নতুন করে বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদলে দিতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষকের মত।
সাগর উত্তাল: চীন-রাশিয়ার যৌথ মহড়া এবং মার্কিন প্রতিক্রিয়া
২০২৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার উস্কানিমূলক বিবৃতির জবাবে দু’টি পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েন করেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাতে চীন ও রাশিয়া সাগরজুড়ে যৌথ নৌমহড়া পরিচালনা করে।
এই মহড়া “Maritime Interaction-2025” নামে পরিচিত। প্রধান অনুশীলন ছিল:
- শত্রুপক্ষের সাবমেরিন খুঁজে বের করে ধ্বংস করা (সিমুলেটেড)
- জাহাজ ও বিমান সমন্বয়ে বহুমাত্রিক প্রতিরক্ষা কৌশল
এই অনুশীলনের সময় ও স্থান নির্বাচন ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ(Sea of Japan)। এটি মার্কিন সাবমেরিন মোতায়েনের সরাসরি প্রতিক্রিয়া এবং চীন-রাশিয়া সামরিক সমন্বয়ের প্রতীক।
“কনস্ট্যান্ট ফিনিক্স”: ভুল বোঝাবুঝির অবসান
অনেকে একটি কথিত মার্কিন কৌশলগত চুক্তির নাম “Constant Phoenix” উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই। এটি সম্ভবত একটি ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তি। “Constant Phoenix” নামটি মূলত মার্কিন এয়ারফোর্সের একটি বায়ু পর্যবেক্ষণ মিশনের নাম, যা পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই কারণে এটিকে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বলে ভুল বোঝা সঠিক নয়। এটিকে রাশিয়ার নিকটে ডিপ্লয় করা হয়েছিল, রাশিয়া কোনো নিউক্লিয়ার ক্রুজ মিসাইল টেস্ট করছে কিনা, সেটার ওপর নজরদারি করার জন্য।
কোয়াড সম্মেলন এবং ভারত-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন
২০২৫ সালের শেষের দিকে ভারতের কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করার কথা। কোয়াড (QUAD) হলো:
- যুক্তরাষ্ট্র
- ভারত
- জাপান
- অস্ট্রেলিয়া
এই চার দেশের কৌশলগত জোট মূলত চীনের প্রভাব প্রতিহত করতে গঠিত হয়েছে। তবে সমস্যা তৈরি হয়েছে ট্রাম্পের নীতি নিয়ে। তিনি:
- ভারতের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন । 25 % কার্যকর এবং বাকি 25% ২৬ আগষ্ট থেকে কার্যকর হবে, যদি না কোনো ডিল সাইন হয়।
- রাশিয়া থেকে তেল আমদানির কারণে ভারতকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন
এই অবস্থানে ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নের মুখে পড়ছে। যদি কোয়াড সম্মেলন স্থগিত হয়, তবে এটি চীন-বিরোধী জোটের উপর বড় ধাক্কা হতে পারে।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রবণতার বিশ্লেষণ
এই সকল ঘটনাগুলো একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এবং বিশ্ব রাজনীতির নতুন চেহারা উপস্থাপন করছে। মূল কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো:
১. চীন-রাশিয়া জোটের উত্থান
- “নো-লিমিটস পার্টনারশিপ” এখন বাস্তব
- সামরিক অনুশীলন, যৌথ মহড়া এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতা এই জোটকে শক্তিশালী করছে
- পশ্চিমা শক্তিগুলির চ্যালেঞ্জ হিসেবে আত্মপ্রকাশ
২. মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে আস্থা সংকট
- ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির ফলে ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি
- কোয়াডের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা
- ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গেও সম্পর্কের টানাপোড়েন অব্যাহত
৩. বহুধ্রুবীয় বিশ্বব্যবস্থা গঠনের সূচনা
- যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য ভাঙছে
- রাশিয়া ও চীন একযোগে নতুন মেরু তৈরির প্রচেষ্টায়
- ভারত, সৌদি আরব, ব্রাজিলের মতো দেশগুলিও নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী পথ বেছে নিচ্ছে
৪. বাণিজ্য ও নিষেধাজ্ঞা: আধুনিক কূটনীতির হাতিয়ার
- তেল, গ্যাস, অস্ত্র কেনাবেচা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির হিসাব বদলাচ্ছে
- যুক্তরাষ্ট্র এখন অস্ত্রের বদলে অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে ভূরাজনীতি চালাচ্ছে
- এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৌশলগত স্বাধীনতা সংকটে পড়ছে
উপসংহার
২০২৫ সাল বিশ্ব রাজনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার শক্তির ভারসাম্য বদলে যাচ্ছে। একদিকে রাশিয়ার শক্তি প্রদর্শনের মহড়া, অন্যদিকে চীনের কৌশলগত সহানুভূতি—সব মিলিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়ছে।
ভারতের জন্য এই সময়টা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে তাকে মার্কিন জোটের অংশ হিসেবে থাকতেও হচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করাও দরকার। ট্রাম্পের নেতৃত্বে যদি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের উপর চাপ বাড়াতে থাকে, তবে ভারতকে নিজস্ব কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। ভারত ধীরে ধীরে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে।
সব মিলিয়ে, বর্তমান বিশ্বরাজনীতি আর একমেরু নয়। এখন শুরু হয়েছে নতুন এক বহুমেরু বিশ্ব—যেখানে প্রতিটি দেশকে কৌশলগতভাবে আরও সাবধানে হাঁটতে হবে।