ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই নানা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে কৃষি ও দুগ্ধ বাজারে প্রবেশাধিকার নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কৃষি ও দুগ্ধ বাজারে বৃহত্তর প্রবেশাধিকার পেতে দৃঢ় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর পেছনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত নানা কারণ রয়েছে। কিন্তু ভারত তার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি, সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে এই দাবির বিরোধিতা করছে। এই প্রবন্ধে আমরা মার্কিন আগ্রহের মূল কারণ, ভারতের প্রতিরোধের কারণ এবং এই ইস্যুর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

১. মার্কিন আগ্রহের মূল কারণ
ক) বাজারের আকার ও সম্ভাবনা
ভারতের জনসংখ্যা বর্তমানে ১.৪ বিলিয়নেরও(১৪০ কোটি) বেশি, এবং দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই বিশাল জনগোষ্ঠী খাদ্যপণ্যের জন্য একটি অপরিসীম বাজার সৃষ্টি করেছে। মার্কিন কৃষি দপ্তর (USDA) মনে করে, ভারতের বাজার বিশেষ করে পশুখাদ্য, দুগ্ধজাত পণ্য, ভোজ্যতেল এবং নানা ধরনের কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে ভুট্টা, সয়াবিন ও তুলা রপ্তানিতে আগ্রহী। ভারতের পশুখাদ্যের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, আর তুলার ক্ষেত্রে ভারত সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানিকারক থেকে আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে এই পণ্যগুলোর অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। ফলে ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার মার্কিন কৃষি অর্থনীতির জন্য একটি বড় সুযোগ।
এছাড়াও, মার্কিন কৃষকরা বর্তমানে অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে রপ্তানির ওপর ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। চীনসহ অন্যান্য বাজারে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক টানাপোড়েন দেখা দিলে ভারতের মতো বড় ও ক্রমবর্ধমান বাজারে প্রবেশাধিকার তাদের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি করতে পারে।
খ) মার্কিন কৃষকদের রাজনৈতিক প্রভাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি ও দুগ্ধ খাত রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। বিশেষ করে গ্রামীণ রাজ্যগুলোতে এই খাতের ভোটব্যাংক বড় এবং তারা প্রায়ই প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস সদস্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বিভিন্ন মার্কিন প্রশাসন বাণিজ্য আলোচনায় কৃষি রপ্তানিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, কারণ এটি রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড়ের কার্যকর উপায়।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ভারতের সঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ, ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যত পণ্য রপ্তানি করে, যুক্তরাষ্ট্র তার তুলনায় অনেক কম পণ্য ভারতকে বিক্রি করে। কৃষি ও দুগ্ধ পণ্য রপ্তানি বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই ঘাটতি কমাতে এবং সম্পর্ককে “ন্যায্য” বা “পারস্পরিক লাভজনক” আকারে উপস্থাপন করতে চায়।
গ) বাজারে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা দূর করা
ভারত ঐতিহ্যগতভাবে কৃষি ও দুগ্ধ খাতে উচ্চ আমদানি শুল্ক আরোপ করে এসেছে। এর মূল উদ্দেশ্য দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সুরক্ষা প্রদান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় এই শুল্ক হ্রাস বা সম্পূর্ণ বিলোপ করা হোক, যাতে তাদের পণ্য ভারতীয় বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়।
এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি উৎপাদনের একটি বড় অংশ জেনেটিকালি মডিফায়েড (GM) পণ্য, যেমন ভুট্টা ও সয়াবিন। ভারত খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থানীয় কৃষির ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগের কারণে এই ধরনের পণ্য আমদানি করতে অনিচ্ছুক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এদের জন্য বাজার উন্মুক্ত করার দাবি জানাচ্ছে।
ভারত দুগ্ধ পণ্যের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু অ-শুল্ক বাধা (non-tariff barriers) বজায় রেখেছে, যেমন স্যানিটারি সার্টিফিকেশন ও পশুখাদ্য সংক্রান্ত ধর্মীয় বিধিনিষেধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এগুলোকে সুরক্ষাবাদী নীতি বলে মনে করে।
২. ভারতের প্রতিরোধের কারণ
ক) ক্ষুদ্র কৃষকদের সুরক্ষা
ভারতের কৃষি খাত মূলত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের দ্বারা পরিচালিত। বৃহৎ আকারের যান্ত্রিক ও উচ্চ ভর্তুকিপ্রাপ্ত মার্কিন খামারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারবে না। যদি বাজার উন্মুক্ত করা হয়, তবে সস্তা আমেরিকান পণ্যে ভেসে যাবে ভারতীয় বাজার, ফলে লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ পরিবারের জীবিকা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
খ) খাদ্য নিরাপত্তা
ভারতের কৃষি নীতির অন্যতম মূল ভিত্তি হলো খাদ্যে আত্মনির্ভরতা। অতীতে বিদেশি খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরতার অভিজ্ঞতা ভারতকে শিখিয়েছে যে, খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বিদেশি আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন করতে পারে।
গ) দেশীয় রাজনীতি
ভারতের গ্রামীণ ভোটব্যাংক রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকরা প্রায় সব রাজনীতিক দলের জন্যই একটি বড় সমর্থকগোষ্ঠী। যদি সরকার কৃষি বাজার উন্মুক্ত করে দেয় এবং এর ফলে কৃষকদের ক্ষতি হয়, তবে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে ব্যাপক। এজন্যই প্রায় সব সরকার কৃষি ও দুগ্ধ খাতকে বাণিজ্য আলোচনায় “লাল রেখা” হিসেবে ধরে রাখে।
৩. দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব
কৃষি ও দুগ্ধ বাজারে প্রবেশাধিকার নিয়ে এই টানাপোড়েন শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও চাপ তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই এই ইস্যুকে বৃহত্তর বাণিজ্য চুক্তির অংশ হিসেবে তুলে ধরে, যেখানে প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও সেবা খাতও আলোচনায় থাকে।
ভারত তার অংশীদারিত্ব বজায় রাখতে চায়, কিন্তু একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কৃষি স্বার্থ রক্ষাও জরুরি মনে করে। ফলে আলোচনা প্রায়ই দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং অনেক সময় কোনো চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছানো যায় না।
৪. সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চিত্র
যদি ভারত কিছু শর্তসাপেক্ষে বাজার উন্মুক্ত করে, তবে মার্কিন কৃষি পণ্য সীমিত আকারে প্রবেশ করতে পারে। তবে এতে ভারতীয় কৃষকদের জন্য ক্ষতিপূরণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন হতে পারে।
অন্যদিকে, যদি ভারত তার বর্তমান নীতি বজায় রাখে, তবে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো অন্যান্য খাতে চাপ সৃষ্টি করে ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করবে, যেমন শুল্ক বৃদ্ধি, ভিসা নীতি পরিবর্তন বা প্রযুক্তি রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ। এর কিছু কিছু আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করছি, কারণ ট্রাম্পের ভোটব্যাঙ্ক এর একটা বড় অংশ হলো এই আমেরিকান কৃষক গোষ্টি।
উপসংহার
ভারত-মার্কিন কৃষি ও দুগ্ধ বাজারে প্রবেশাধিকার নিয়ে বিরোধ কেবলমাত্র বাণিজ্যিক ইস্যু নয়; এটি দুই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ, সামাজিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক কৌশলের প্রতিফলন। একদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার কৃষি উৎপাদনের জন্য ভারতের বিশাল বাজারকে লক্ষ্য করছে, অন্যদিকে ভারত তার ক্ষুদ্র কৃষক, খাদ্য নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় অনড়।
দুই দেশের মধ্যে এই ইস্যুতে সমঝোতা আসবে কি না, তা নির্ভর করবে উভয়ের পারস্পরিক ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা এবং বৃহত্তর কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখার ইচ্ছার ওপর। ভবিষ্যতে, যদি এই বিষয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তি হয়, তবে তা শুধু বাণিজ্য নয়, বরং কূটনৈতিক সম্পর্ককেও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।