মর্যাদার আনন্দঘন মুহূর্তে মৃত্যু: বেঙ্গালুরুতে আরসিবি’র জয় উদযাপনে মর্মান্তিক পদদলিত দুর্ঘটনা

২০২৫ সালের ৪ জুন, বেঙ্গালুরুর এম. চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের সামনে লাখো মানুষের আনন্দ, চিৎকার আর উৎসব হঠাৎ রূপ নেয় মৃত্যুর নিঃসঙ্গ আহাজারিতে। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (RCB)-এর আইপিএল জয় উদযাপন ঘিরে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক পদদলিত (স্ট্যাম্পিড) দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছেন। একটি আনন্দঘন ঐতিহাসিক মুহূর্ত নিমেষেই পরিণত হয় বিষাদে।
দুর্ঘটনার মূল ঘটনা
-
স্থান ও সময়: ৪ জুন, ২০২৫, বিকেল প্রায় ৪টা নাগাদ চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের গেট নম্বর ৩-র সামনে বিপুল জনসমাগমে হঠাৎ করে পদদলিত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
-
উৎসব উপলক্ষ: ১৮ বছরের অপেক্ষার পর অবশেষে RCB তাদের প্রথম আইপিএল ট্রফি জিতেছে। সেই জয়কে উদযাপন করতেই হাজার হাজার সমর্থক স্টেডিয়ামের দিকে ছুটে আসেন।
-
মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা: অন্তত ১১ জন মারা গেছেন, যাঁদের অধিকাংশই যুবক ও যুবতী। প্রায় ৪৭-৫০ জন আহত হয়েছেন, এর মধ্যে ২৭ জনকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
-
মূল কারণ:
- জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা: বেঙ্গালুরুর মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২-৩ লক্ষ মানুষ স্টেডিয়ামের আশেপাশে জড়ো হয়েছিলেন, যেখানে স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা মাত্র ৩৫ হাজার।
- ফ্রি পাস বিতরণে বিভ্রান্তি: অনেকেই ফ্রি পাস না পেয়েও প্রবেশ করতে গিয়েছিলেন, ফলে গেট খোলার সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
- গেট ৩ আংশিক খোলা: হঠাৎ করেই গেট ৩ আংশিকভাবে খোলার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল ভিড় একসঙ্গে প্রবেশের চেষ্টা করে এবং ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়।
- সহযোগিতা ও কন্ট্রোলের অভাব: প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, যাঁরা পড়ে যান তাঁদের সাহায্য করার মতো কোনও নিরাপত্তা কর্মী বা পুলিশ উপস্থিত ছিল না।
আরসিবির বিজয় ও উদযাপন
-
ভিড়ের পটভূমি: রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর জন্য ২০২৫ সালের আইপিএল ছিল একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। দীর্ঘ ১৮ বছরের ট্রফি-খরা কাটিয়ে অবশেষে শিরোপা জয় করে তারা। এই জয় কেবল দলটির জন্য নয়, গোটা বেঙ্গালুরুর জন্য গর্বের মুহূর্ত ছিল।
-
উৎসবের রূপরেখা:
- সকালবেলা দলের খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা জানানো হয় বিধান সৌধে।
- এরপর র্যালির মাধ্যমে তারা চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে পৌঁছান।
- স্টেডিয়ামে মূল উদযাপন অনুষ্ঠান চলছিল যখন বাইরে এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে।
-
খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া:
- বিরাট কোহলি সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, “আমি বাকরুদ্ধ, এই ট্র্যাজেডি মেনে নেওয়া খুব কঠিন।”
- আরসিবি ও কর্ণাটক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে শোকবার্তা প্রকাশ করে এবং মৃতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানায়।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও তদন্ত
-
মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া:
- তিনি ঘটনার জন্য অতিরিক্ত জনসমাগমকে দায়ী করেন।
- মৃতদের পরিবারকে ₹১০ লক্ষ করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন।
- একটি ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেন, যার রিপোর্ট ১৫ দিনের মধ্যে জমা দেওয়া হবে বলে জানান।
-
ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী ডি.কে. শিবকুমার:
- তিনি জনতার কাছে শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং ক্ষমা চান।
- বিরোধী দল বিজেপিকে এই ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করার আহ্বান জানান।
-
বিরোধীদের সমালোচনা:
- কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি নেতারা সরকারের প্রস্তুতির অভাব, অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার জন্য কড়া সমালোচনা করেন।
শহরের ওপর প্রভাব
-
মেট্রো পরিষেবা ব্যাহত:
- বিপুল ভিড়ের কারণে BMRCL (Bangalore Metro Rail Corporation) কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মেট্রো স্টেশন যেমন সেন্ট্রাল কলেজ, বিধান সৌধ, কাব্বন পার্ক এবং এম.জি. রোড বন্ধ করে দেয়।
- কিছু স্টেশনে টোকেন এবং QR টিকিট পরিষেবা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।
-
শহরের মেজাজ:
- গোটা শহরের পরিবেশ আনন্দ থেকে বিষাদের ছায়ায় ছেয়ে যায়। উৎসবের ছবি মুহূর্তে রূপ নেয় অশ্রুভেজা কফিন আর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনে।
অতীতের পদদলিত দুর্ঘটনাগুলির প্রেক্ষাপট
পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ভারতে নতুন নয়। নীচে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার তথ্য দেওয়া হলো:
বছর | স্থান | নিহত | কারণ |
---|---|---|---|
২০০৮ | নৈনাদেবী মন্দির, হিমাচল প্রদেশ | ১৪৫+ | মন্দিরের সিঁড়িতে ভিড় |
২০১৩ | রতনগড় মন্দির, মধ্যপ্রদেশ | ১১৫+ | গুজব ছড়ানো ও ব্রিজ ধ্বসে পড়ার ভয় |
২০১৫ | অন্ধ্রপ্রদেশ, গোদাবরী পুষ্করম মেলা | ২৭ | অতিরিক্ত ভিড় |
২০১৬ | বারানসী, জয় গুরুদেব সমাবেশ | ২৪ | অনুমতির বাইরে ভিড় জমায় |
২০২২ | মাতা বৈষ্ণো দেবী মন্দির, জম্মু | ১২ | নতুন বছর উপলক্ষে বিশাল ভিড় |
বিশ্বব্যাপীও এমন বহু ঘটনা ঘটেছে:
- ২০১৫ সালে হজে মিনার সময় পদদলনে ২,০০০+ মানুষ মারা যান।
- ২০১০ সালে কাম্পালা (উগান্ডা) স্টেডিয়ামে ৭৪ জন নিহত হন।
এসব ঘটনা একটাই শিক্ষা দেয়— জনসমাগম যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে যেকোনো আনন্দঘন অনুষ্ঠানও মৃত্যুর মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে।
শিক্ষণীয় দিক ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
এই দুর্ঘটনা ভারতের প্রশাসন এবং জননিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি গভীর ব্যর্থতা স্পষ্ট করে দেয়। আগামীতে এই ধরনের জনসমাবেশ আয়োজনের আগে নিচের বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া আবশ্যক:
- সুনির্দিষ্ট জনসংখ্যা অনুমান ও নিয়ন্ত্রণ
- প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য পর্যাপ্ত গেট
- মেডিক্যাল এবং অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুতি
- সিসিটিভি ও ড্রোন মনিটরিং
- সুশৃঙ্খল পাস ও টিকিট ব্যবস্থা
- মাঠ ও রাস্তার পর্যাপ্ত আলোকসজ্জা ও নির্দেশিকা বোর্ড
উপসংহার
একটি ঐতিহাসিক ক্রীড়া বিজয় উদযাপন, যা সারা শহরকে গর্বিত করেছিল, সেটাই একটি ট্র্যাজেডির রূপ নিল। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জনসমাগম নিয়ে উদাসীনতা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। আরসিবি-র জয় যেমন এক যুগান্তকারী মুহূর্ত, তেমনি এই ট্র্যাজেডিও ইতিহাসে লেখা থাকবে এক কালো অধ্যায় হিসেবে।
আমরা আশা করি, এই দুঃখজনক ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য একটি জাগরণ ঘটাবে এবং সরকার ও প্রশাসন আরও সতর্ক হবে জনসুরক্ষা নিশ্চিত করতে। মৃতদের আত্মার শান্তি কামনা করি এবং তাদের পরিবারগুলির প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।