সিন্ধু পানি চুক্তি: ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে এক জলবন্টন নিদর্শন
বিশ্বের জলসম্পদ বণ্টন নিয়ে অনেক রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা গেলেও, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ। ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান জলবন্টন সংক্রান্ত বিরোধ নিরসনে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এটি শুধু একটি পানি বণ্টন চুক্তিই নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতি, প্রযুক্তিগত আলোচনার দৃষ্টান্ত এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক অনন্য নিদর্শন।
চুক্তির পটভূমি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর সিন্ধু নদ অববাহিকার জলসম্পদ নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। সিন্ধু অববাহিকার প্রধান নদীগুলির উৎস ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত হলেও, নদীগুলির প্রবাহ পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, যা পাকিস্তানের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিভাজনের পর পরই, ১৯৪৮ সালে ভারত থেকে পাকিস্তানের প্রবাহমান পানির প্রবাহ কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা পাকিস্তানে তীব্র উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এর ফলে দু’দেশের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সেই থেকে শুরু হয় এক দীর্ঘ আলোচনার পর্ব, যেখানে বিশ্বব্যাংক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। শেষ পর্যন্ত, ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের করাচিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ স্বাক্ষর করেন।
চুক্তির মূল বৈশিষ্ট্য
সিন্ধু পানি চুক্তির অধীনে সিন্ধু নদ অববাহিকার মোট ছয়টি নদীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
১. পূর্বাঞ্চলীয় নদীসমূহ (ভারতের জন্য বরাদ্দ):
- রবি (ইরাবতী)
- বিয়াস (বিপাশা)
- সুতলেজ (শতদ্রু)
এই নদীগুলির পানি ভারত সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারে কৃষিকাজ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য।
২. পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীসমূহ (পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ):
- সিন্ধু
- ঝিলম
- চেনাব
এই নদীগুলির ৮০% পানি পাকিস্তান ব্যবহার করে এবং চুক্তি অনুযায়ী ভারত এগুলোর পানি সীমিতভাবে ব্যবহার করতে পারে, যেমন:
- সেচের সীমিত কাজ
- জলবিদ্যুৎ উৎপাদন (যেখানে জল পুনরায় নদীতে ফিরে যায়)
- নৌচলাচল
- মাছ চাষ
তবে, ভারতের ওপর কঠোর নিয়ম আরোপ করা হয়েছে যাতে সে নদীগুলির প্রবাহের গতিপথ বড় পরিসরে পরিবর্তন না করে এবং পানির প্রবাহও অধিক সময় আটকে না রাখে। প্রকল্পের ডিজাইন এবং বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানতে হয়।
চুক্তির প্রযুক্তিগত দিক ও কার্যকারিতা
চুক্তির অংশ হিসেবে একটি স্থায়ী ইন্দাস কমিশন গঠিত হয়েছে যা প্রতি বছর দুইবার বৈঠক করে এবং উভয় দেশকে নদীর জলসম্পদ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ও পরিকল্পনা জানাতে বাধ্য করে। যদি কোনো প্রকল্প নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে সেই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্দিষ্ট ধাপে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে:
- দ্বিপাক্ষিক আলোচনা
- নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের মতামত গ্রহণ
- আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের হস্তক্ষেপ
এই সুনির্দিষ্ট বিধান চুক্তির দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করেছে।
চুক্তির ভূমিকা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে
সিন্ধু পানি চুক্তি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে একটি ‘স্ট্যাবিলাইজিং ফ্যাক্টর’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। রাজনৈতিক ও সামরিক টানাপোড়েনের মধ্যেও এই চুক্তি প্রায় অক্ষত থেকেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ, এমনকি উরি ও পুলওয়ামা হামলার পরেও এই চুক্তি কার্যকর থাকায় এটি উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে দেখা যায়।
এছাড়াও, চুক্তিটি ভারতকে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর উপর সীমিত হস্তক্ষেপের অধিকার দেয়। এই অধিকারকে কাজে লাগিয়ে ভারত অনেক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যেমন:
- বাঘলিয়ার ড্যাম (ঝিলম নদীতে)
- কিশনগঙ্গা প্রকল্প (ঝিলমের একটি উপনদীতে)
এই প্রকল্পগুলো পাকিস্তানের উদ্বেগের কারণ হয়েছে, কারণ তারা মনে করে এতে পানির প্রবাহে হস্তক্ষেপ হতে পারে।
সাম্প্রতিক বিরোধ ও বিতর্ক
২০১৬ সালে উরিতে জঙ্গি হামলার পর ভারত সরকার সিন্ধু পানি চুক্তি পুনর্বিবেচনার কথা জানায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই সময় বলেছিলেন: “রক্ত আর জল একসঙ্গে বইতে পারে না।” যদিও ভারত এখনো একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করেনি, কিন্তু পাকিস্তান এটিকে এক প্রকার চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে দেখে।
বর্তমানে ভারতের পাহেলগামে একটি জঙ্গি হামলা হওয়ার পর ভারত এই জলচুক্তি অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড করে দিয়েছে। এই নিয়ে পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক নেতা কঠোর বার্তা দিলেও, ভারত তাতে কর্ণপাত করেনি।
পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলে অভিযোগ জানিয়ে বলেছে, ভারতের কিছু প্রকল্প আন্তর্জাতিক মানদণ্ড লঙ্ঘন করছে। একাধিকবার তারা এই বিষয়টিকে ‘জল যুদ্ধ’ বলেও অভিহিত করেছে।
অন্যদিকে, ভারত দাবি করে, তারা চুক্তির সব শর্ত মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং পাকিস্তানের আপত্তিগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতি, হিমবাহ গলে যাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা—সব মিলিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা আরও জটিল হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে সিন্ধু পানি চুক্তির কার্যকারিতা, স্থায়িত্ব ও নমনীয়তা নিয়ে নতুনভাবে ভাবার সময় এসেছে।
বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক জলসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চুক্তিকে আধুনিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে পারে প্রযুক্তিগত হালনাগাদ, উপগ্রহচিত্র পর্যবেক্ষণ, এবং স্বচ্ছ তথ্য বিনিময়। কিন্তু পাকিস্তান যতদিন না জঙ্গি নিকাশ করছে, ততদিন ভারত কোনো তথ্য বিনিময় করবে না বলেও আশা করা হচ্ছে।
উপসংহার
সিন্ধু পানি চুক্তি শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি কূটনৈতিক সাফল্য নয়, এটি বিশ্বে আন্তঃসীমান্ত জলবন্টনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। যুদ্ধ, রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও আস্থাহীনতার মাঝেও এই চুক্তির স্থায়িত্ব বলে দেয় যে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিরোধের মীমাংসা সম্ভব — যদি ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকে।
ভবিষ্যতে এই চুক্তিকে টিকিয়ে রাখতে হলে উভয় দেশকে কেবল চুক্তির শর্ত মানলেই চলবে না, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্বচ্ছতা ও বৈজ্ঞানিকভাবে পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, আগামী দিনের যুদ্ধ হতে পারে “জলের” জন্য, আর সিন্ধু পানি চুক্তির মতো উদাহরণই হতে পারে সেই সংঘর্ষ রুখে দেওয়ার একমাত্র পথ।
বিষয়: জলসম্পদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভারত-পাকিস্তান
ক্যাটাগরি: ইতিহাস ও সমসাময়িক রাজনীতি
নিচে সিন্ধু পানি চুক্তি সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ FAQs (Frequently Asked Questions) বা প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর দেওয়া হলো,
১. সিন্ধু পানি চুক্তি কবে এবং কোথায় স্বাক্ষরিত হয়?
উত্তর:
সিন্ধু পানি চুক্তি ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের করাচিতে স্বাক্ষরিত হয়।
২. এই চুক্তিটি কারা স্বাক্ষর করেন?
উত্তর:
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। বিশ্বব্যাংক এতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
৩. সিন্ধু পানি চুক্তির মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর:
চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু নদ অববাহিকার ছয়টি নদীর পানির ন্যায়সঙ্গত বণ্টন নিশ্চিত করা এবং এই নিয়ে সংঘর্ষ বা বিরোধ এড়ানো।
৪. কোন নদীগুলো ভারতের জন্য বরাদ্দ?
উত্তর:
ভারতের জন্য বরাদ্দ পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি নদী:
- রবি (ইরাবতী)
- বিয়াস (বিপাশা)
- সুতলেজ (শতদ্রু)
৫. পাকিস্তানের জন্য কোন নদীগুলো বরাদ্দ করা হয়েছে?
উত্তর:
পশ্চিমাঞ্চলীয় তিনটি নদী পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ:
- সিন্ধু
- ঝিলম
- চেনাব
৬. ভারত পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর পানি ব্যবহার করতে পারে কি?
উত্তর:
হ্যাঁ, ভারত সীমিত সেচ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন (যেখানে পানি পুনরায় নদীতে ফিরে যায়), নৌচলাচল ও মাছ চাষের জন্য এই নদীগুলোর পানি ব্যবহার করতে পারে। তবে চুক্তি চলাকালীন পানি আটকে রাখা বা প্রবাহে বড় ধরনের পরিবর্তন নিষিদ্ধ।
৭. চুক্তির কোনো নিরীক্ষণ বা তদারকি ব্যবস্থা আছে কি?
উত্তর:
হ্যাঁ, চুক্তির আওতায় একটি স্থায়ী ইন্দাস কমিশন গঠিত হয়েছে, যা বছরে অন্তত দু’বার বৈঠক করে এবং উভয় দেশকে নিয়মিত তথ্য বিনিময় করতে হয়। যা চুক্তি সাসপেন্ড হওয়ার পর হবে বলে আর মনে হয় না।